"বিশ্ববিদ্যালয়" আসলে কিসের জন্য এবং কেন? একটি ইতিহাসের উপর বিশ্লেষণ।



- বিশ্ববিদ্যালয় সবারই একটি স্বপ্ন,একটি আশ্বাসের নাম। কারণ এই মাত্রায় তাকে মুখোমুখি হতে হয় নতুন এক জীবনের সন্ধানে যেখানে সে মেটাতে পারবে তার মনের আশা। কাড়ি কাড়ি টাকার স্বপ্ন দেখে প্রত্যেক ছেলে মেয়ে, পরিবারের স্বপ্ন থাকে অনেক বেশি বড় কিছু হবে, টাকা পয়সা ইনকাম করে সংসার জগত এবং নিজের খরচ চালাবে। আর বিসিএস কিংবা বিজনেস করলে তো কথাই নেই, পড়ালেখা কিসের অফিশিয়াল সম্মান আগের ব্যাপার স্যাপার। আরেকদলের স্বপ্ন থাকে পড়ালেখা মুখস্ত করে ডিপার্টমেন্টে চমৎকারভাবে বা ঐশ্বরিকভাবে মুখস্ত বিদ্যা অর্জন করে ভালো নম্বর তুলতে পারবে। ক্লাসে তার মূল আখ্যান বা ব্যাখ্যা না বুঝে বইয়ে কি লাইন লিখা আছে সেটি মুখস্ত করেই ব্যাস হয়ে গেল তার ফার্স্ট ক্লাস রেজাল্ট। আবার অনেকে তো কে কি বললো কোনো কিছুই মাথা ঘামায় না, হালকা পড়ে কোনোভাবে রেজাল্ট নিয়ে বিজনেসে নামার টার্গেট তার। অসম্ভব ভালো মানের টাকা কড়ি অর্জন করতে পারবে। আবার অনেকে আছে কিছু না বুঝেই ঝরঝর করে শব্দভান্ডার গলাঃধকরণ করবার চেষ্টা করে আপ্রাণ ভাবে, তার কাছে সেই পদক্ষেপে বুঝে নেওয়াটা যেন লজ্জাস্কর ব্যাপার স্যাপার। অনেকে তো আছে বলে বেড়ায় পড়ে লাভ কি! ভবিষ্যৎ তো একেবারেই নেই, আবার কেউ কেউ তো বলে "এই পড়া পড়লে কি মাথা থাকবে!পড়ে লাভ কি!" 
  বিশ্ববিদ্যালয় তো তার জায়গা থেকে সে বানাচ্ছে আর সবাই বসে বসে খেয়েই চলছে।



যাইহোক এতো সকল ডায়মেনশন নিয়ে গঠিত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও ছাত্র ছাত্রীরা যতোটা না বিশ্ববিদ্যালয় নামটা নিয়ে সচেষ্ট তার চেয়ে বেশি সচেষ্ট কোনটা প্রাইভেট আর কোনটা পাবলিক, কোনটায় ট্যাগমূল্য বেশি আর কোনটায় ট্যাগ মূল্য কম। এটা আসলে আমাদের ছাত্র ছাত্রীদেরও দোষ নয় বৈকি! ছোট বেলা থেকে জন্মের পর অর্থের ভূত আর বিষবাষ্প ঢুকে পড়ে এই সোশালাইজেশন প্রক্রিয়ায়, এখন এখানে জ্যা জ্যাক রুশো আলাপে মনস্থিরকে নষ্ট করিয়া লাভ নেই, তবুও ব্যাখ্যাতীত বিশ্লেষণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ এর পেছনের দায় কিভাবে তারা এবং কেন। উত্তর সময়সাপেক্ষ। যাইহোক যে আলাপে আছি সেটি হলো, এই ছাত্র ছাত্রীরা যাদের প্লেটো থেকে শুরু করে সক্রেটিস পর্যন্তও ভাবতেন তারা হলো প্রকৃতির এক অনন্য নিয়ামক, যাদের জ্ঞানের পর্বতের চূড়া আকাশচুম্বী তাহলে প্রশ্নটি হলো আসলেও তারা প্রকৃত অর্থে আকাশচুম্বী? ভেবে দেখুন একটু কতোক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আসলে কি কি করে গিয়েছেন। এই আলাপেও যাবো না, আসলে যে আলাপ করবার জন্য মনস্থির করেছি তা হলো এই যে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে হরেক ধরনের ডায়মেনশন রয়েছে ,এই যেমন অর্থ কল্পনা, রসনা,বিলাসিতার স্বপ্ন কি আসলেই “বিশ্ববিদ্যালয়” শব্দটি বহন করে? দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয় বলতে আমরা যা বুঝি হালকা পাতলা আসলেই কি আমরা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ছি নাকি শুধু স্বপ্ন দেখাবার কারিগরি শিক্ষা কেন্দ্রে পড়ছি, যদি তাই হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় পড়বার আগেই সকলকে এইটা বুঝা উচিত নয় কি যে আসলে “WHAT IS UNIVERSITY?”বিশ্ববিদ্যালয়ের তবে তাৎপর্য কি? এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আদি পর্বের ধারণায় কি ছিল? আসলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন কি? জ্ঞান নাকি অর্থ? বিলাসিতা নাকি নৈতিক শিক্ষার স্থান? প্রজ্ঞাবোধের চর্চা নাকি কল্পনার চর্চা? ইনডিভিজুয়ালিস্টিক হয়ে গড়ে উঠা নাকি কালচারালি আবদ্ধ হয়ে গড়ে উঠা? বিশ্ববিদ্যালয়কি মানুষ হতে শেখায় নাকি মানুষের উর্ধ্বে টাকাকে সে প্রাধান্য দেয় (ছাত্র-ছাত্রী এবং বিশ্ববিদ্যালয় নিজে উভয়েই)। অর্থ তো অবশ্যই প্রয়োজন তাই বলে সমগ্র জীবনটিই কি অর্থ দ্বারা সংজ্ঞায়িত করতে শেখায়?
তো বলা চলে এখানে শুধুই যে ছাত্র ছাত্রীর দোষ এটা মোটেও রেলেভেন্ট নয় বরং এর মধ্যে কিছু সিগনিফিকেন্ট অবজেক্টস রয়েছে, যেমন রাষ্ট-সমাজ-বিশ্ববিদ্যালয়। এমনও হতে পারে রাষ্ট্রের অব্জেক্টিভে জ্ঞানের গোল নেই বা ছাত্র- ছাত্রীর অব্জেক্টিভে জ্ঞানের গোল নেই, আবার হতে পারে উভয়েই একই দোষে দুষ্ট। এক পক্ষকে দোষারোপ করার মাধ্যমে আপেক্ষিকতার নীতি এখানে কাজে লাগাতে চাই না। বিশ্লেষণে যাই আদিমের রূপরেখা নিয়ে- 


ইতিহাস এবং পর্যালোচনাঃ




আজকের যুগের মতো বিশ্ববিদ্যালয় বলতে আদিমকালে বা আদি পর্বের উত্থানের সময় এমনটি ছিল না। যেটি মূলত “ইউনিভার্সিটি” হচ্ছে Universitas Facultatum, অর্থাৎ এমন এক শিক্ষায়তন, যেখানে জ্ঞানের সব কটি ফ্যাকাল্টি বা শাখার সাথে পরিচিত হওয়া যায়। অর্থাৎ এটি এম একটি স্থান-কাল যে স্থান কালে দাঁড়িয়ে আপনাকে অবশ্যই সকল ধরনের উপাদানের সাথে পরিচিত হতে হবে। একজন ছাত্র জীবনে সমগ্রতা অর্জন হলো আত্নার সর্বোচ্চ কল্যাণ সাধন। একজন সাইন্স পড়ুয়া ব্যাক্তি সারাজীবন সাইন্সের চর্চা করে আর্ট হিউম্যানিটির চর্চা থেকে দূরে থাকার অর্থই হলো কালচারালি তার মানসিক পরিধি বেশ দূর্বল। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে এটি বাস্তবেও সত্য কারণ সাইন্সে যতোটা না এথিক্সের চর্চা হয় তার চেয়ে বেশি অন্য ফ্যাকাল্টিতে আরো অধিখারে চর্চা হয়ে বলে একজন ছাত্রকে প্রতিনিয়ত সকল মাধ্যমের সাথে আবদ্ধ থাকতে হয়। এতে মানসিক এবং দৈহিক আশ্বস্তবোধ এবং সচেতনতার মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়।
এরিস্টটল এ ব্যাপারে কিছু সিদ্ধান্ত আরোপ করেছেন যে আসলে মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন কোন স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ঠ্য থাকলে তাকে  বিশ্ববিদ্যালয় বলা যাবে,

       ১। বিশ্ববিদ্যালয় হলো উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য মাধ্যম(স্কুল কলেজ)শেষ করে সরাসরি উচ্চতর
  জ্ঞান প্রতিষ্ঠান কেন্দ্র হলো বিশ্ববিদ্যালয়।আদি কাল বা আজ থেকে কয়েকশ বছর আগেও আমরা দেখতাম বিভিন্ন দার্শনিক একই সাথে জ্যোতির্বিদ,গণিতবিদ, আইনজ্ঞ, চিন্তাবিদ, সাইকোলজিস্ট ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী বা জ্ঞান রাখেন।

-   ২।বিশ্ববিদ্যালয় বিচিত্র বিষয়ে পাঠদান করাবে। বিষয় যত বেশি বিচিত্র হয় ততই শ্রেয়। বিষয়গুলি পারস্পরিক সম্পর্ক ও সাদৃশ্যের ভিত্তিতে একাধিক অনুষদে বিভক্ত হয়ে থাকে।

-   ৩।বিশ্ববিদ্যালয় কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ইচ্ছায় চলে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনার মূলনীতি হলো গণতন্ত্র। যেখানে মধ্যযুগে ইউরোপে কোথাও গণতন্ত্র ছিল না সেখানে একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে গণতন্ত্র বিরাজমান ছিল।একাধিক স্তরবিশিষ্ট একটি শিক্ষক মন্ডলী দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান সম্পন্ন হয়ঃ অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক,রিডার, প্রভাষক।

   ৪।বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জাতির মস্তিষ্ক,জাতির বিবেক হিসেবে কাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের স্বাধীন চিন্তা চেতনা করবার সুযোগ করে দিবে। ক্রান্তিকালে জাতি বা রাষ্ট্রকে দিকনির্দেশনা দিবে। ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ ও গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অধ্যাপক নিজেকে বিকিয়ে দিবে না। 
বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত এ হলো একটি আদর্শ ধারণা। পড়েই হয়তো বুঝে উঠতে পারছেন এর একটি জিনিসও আসলে কিছুটা মিললেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সব কিছুই আপনার আমার কন্সেপ্টের সাথে বিপরীতমুখী। তাহলে আগের রূপরেখা কেমন ছিল?


সম্রাট শার্লমাইন,শিক্ষার প্রদীপ আগলে রাখার অন্যতম কারিগর নামে খ্যাত, যিনি তার সময়ে লুটেসিয়া পারিসিওরুম(প্যারিসের পুরোনো নাম) শহরে একটি রাজকীয় প্রাসাদ বিদ্যালয় গড়ে তুলে। আলকুইন এখানের পরিচালক এবং একই সাথে শিক্ষক ছিলেন। সম্রাট নিজেও তার কাছে শিক্ষা নিতেন, তিনি সর্বদা জ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন শুধু তাই নয় বরং রাজসভায় জ্ঞানীদের স্থান দিতেন। শার্লমাইন বিশ্বাস করতেন মানব্ জীবনের পরিপূর্ণতা আসে শিক্ষা থেকে আর তাই তিনি গির্জা থেকে শুরু করে প্রতিটি জায়গায় আরো বিদ্যালয় গড়ে তুলেন। নিছক অর্থ নয় বরং জ্ঞান চর্চা করতে শুধুমাত্র ইচ্ছুক এমন বহু ছাত্র ছাত্রী সেখানে অংশগ্রহণ করেছে।
এরই মধ্যে গঠিত হয় ত্রয়োদশ শতকে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়। ফ্রান্সের নানান প্রান্তর থেকে মূল চর্চা কেন্দ্র প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় আসে শুধুমাত্র জ্ঞানের জন্য। প্লেটোর তত্ত্ব অনুসারে জ্ঞানের সংজ্ঞায়ন হলো যা অর্থ বা কল্পনা শেখায় না, শেখায় আধার গুহা থেকে আলোতে এসে মুক্ত চিন্তা ধারার চর্চা এবং নৈতিকতার চর্চাকে। প্লেটো সমর্থন দিয়েছেন নতুন জ্ঞানকে উৎপাদন করবার জন্য যে জ্ঞান মানব জাতিকে দেখাবে আগাম বার্তা। যেমনঃ- স্টোয়িক দর্শন,মাইলেসীয় দর্শন ইত্যাদি ধরনের। ইউরোপে এই ছোট ছোট বিদ্যালয় থেকে আস্তে আস্তে বর পরিসরে জ্ঞান ও প্রজ্ঞাবোধের চর্চার জন্য সৃষ্টি হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় যেটাকে আমি অপর ভাষায় বলতে পারি কোনো ক্লাসে বাধ্য বা ক্লাসে বসে শিক্ষা নয় বরং বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনামূলক শিক্ষাব্যবস্থা।
মধ্যযুগে রোমান গ্রিকের কয়েকবার আক্রমণের ফলে জ্ঞানচর্চার একটি স্থায়ী বিচ্ছেদ ঘটে ,পুরোপুরি নয়। এই যুগকে তাই অনেকে অন্ধকার যুগ বলে বিবেচনা করে আসলে এই যুগ যতোতা না অন্ধকার তার চেয়ে বেশি নিউ কোয়ালিশনের যুগ বলা চলে। কারণ এ সময় আরব এবং ইউরোপের মধ্যে জ্ঞানের সমন্বয় ঘটে। সপ্তম শতাব্দীতে যখন সমগ্র স্থানে আরবদের জয়সূচক ধ্বনি সেখানে তারা ইউরোপে আবিষ্কার করলো গ্রিক রোমান পান্ডুলিপি। সেখান থেকে সক্রেটিস-প্লেটো-এরিস্টটলের বই অনুবাদ হলো আরবীতে। জ্ঞান চর্চা হলো আরবে এবার গ্রিক রোমানদের চিন্তকদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সমাজব্যবস্থাপনা সংবলিত বিস্তর দর্শন নিয়ে। আরবরা এভাবে স্পেন থেকে শুরু করে অনেক জায়গায় তারা চিকিৎসা, দর্শন,সাহিত্য,রাজনীতি,গণিত এর শিক্ষা নিতে যেত। হরেক রকমের শিক্ষার উদ্দেশ্য সাধণ করেছে ইউরোপ-আরব কোয়ালিশন যুগে।
ইউরোপ জ্ঞান চর্চায় সমৃদ্ধশালী ছিল প্রচুর। বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতি শুরু হবার আগে ছোট ছোট গির্জা, বিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা পড়াতো সাতটি বিষয়- ব্যাকরণ,রেটোরিক(বাচন/অলঙ্কারশাস্ত্র),যুক্তিবিদ্যা,পাটিগণিত,জ্যোর্তিবিদ্যা,জ্যামিতি,সংগীত,দর্শন।
এভাবে চলতে চলতে আমরা পাই পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়, বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। আর দ্বিতীয় হচ্ছে প্যারিস ইউনিভার্সিটি।





পৃথিবীর এই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল ছাত্র সংগঠন এবং দ্বিতীয়টি ছিল শিক্ষক সমিতি।সেই আল্পসের ওপার থেকে ফ্রান্স ইত্যালি বেলজিয়াম দেশ থেকে পড়তে আসতো অনেক ছাত্র।রোমান আইন, দর্শন, যুক্তিবিদ্যা পড়তে আসতো জ্ঞানের জন্য। এমনকি রাজারাও বিশ্বাস করতেন এই সকল জ্ঞান তাদের মানবিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। বোলোনিয়া ছিল ছাত্র সংগঠন যেখানে ছাত্রসংঘের অস্তিত্ব ছিল, নিয়ন্ত্রিত হতো তাদের দ্বারা, ছাত্রদের মতামতদের দ্বারা বিশ্বাস করা হতো গণতন্ত্রের আসল রূপ এবং চূড়ান্ত জ্ঞান আহরণের জন্য ছাত্র ছাত্রীরা যথেষ্ট সচেতন ছিল।  বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনের একেবারে প্রথম দিকে এক স্ট্যাটিউটসে(নিয়মকানুন সহ বিবরণ) লেখা ছিল, কোনো অধ্যাপক আগে ছুটি না নিয়ে ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে পারবেন না, ঘন্টা বাজার সাথে সাথে অধ্যাপক বক্তৃতা শুরু করতেন এবং ঘন্টা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ করতেন, কঠিন পড়া পরে বুঝিয়ে দিবো বললেও অপরাধ বলে গণ্য হতো। কোনো অধ্যায় বাদ দেওয়া যাবে না, লাইন টু লাইন পড়াবে শিক্ষক এবং পড়বে শিক্ষার্থী এই নীতিতে চলতো বোলোনিয়া ইউনিভার্সিটি। কিন্তু একটি জিনিস লক্ষ্যনীয়, এভাবে করে কিন্তু পুরো পৃথিবীর কাছে শুদ্ধ,সঠিক এবং নতুন ধারণাযুক্ত জ্ঞানের প্রসার ঘটাতে সক্ষম ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্র। সে যেই বিষয় হোক না কেন।
অপরদিকে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল শিক্ষকদের ক্ষমতা ছিল বেহসি। কিন্তু তবুও তারা বিশ্বাস করতেন সর্বোচ্চ যোগ্যতা হলো শিক্ষকের প্রধান গুণ এবং যতোক্ষণ পর্যন্ত পরীক্ষা-ভাইবা তে উত্তীর্ণ হতে পারবেন না এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ধরে রাখতে পারবে না,তাকে পরাবার লাইসেন্সও দেওয়া হবে না। এই লাইসেন্সের প্রধান শর্ত জাগতিক ও মানবিক শিক্ষাকে একজন শিক্ষক প্রায়োগিক দৃষ্টিভঙিতেও দেখবে এবং প্রতিটি পদক্ষেপে তার উত্তর থাকতে হবে নিখুত, নতুনের মতোন।





এই দুই বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন সময় এতোই শক্তিশালী ছিল যে তাদের মধ্যে একসময় ছাত্র ছাত্রী আসা যাওয়া করতো নতুন জ্ঞানের সন্ধানে। এই বিশ্ববিদ্যালয় যদি চিকিৎসা বিজ্ঞানে পারদর্শী হয় তাহলে ওই বিশ্ববিদ্যালয় ধর্মতত্ত্ব ও আইনতত্ত্ব বিষয়ে পারদর্শী এবং তারা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমণ করে শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়েছিলো।
তো আসলে মূলত এখন বুঝাই যাচ্ছে একসময়কার শিক্ষা বলতে জ্ঞানের অর্জন আর এখন শিক্ষা বলতে চাকরীকেই বোঝানো হয়। এর দায় যুগের পর যুগ রাষ্ট্রের অপরিপক্বতাকে নিতে হবে, শুধু রাষ্ট্রই নয় বরং সমগ্র বিশ্বের পুজিকেন্দ্রিক মনোভাবকে দায়ী করা উচিত। দেখুন আদির সাথে বর্তমানে আমাদের পার্থক্য-

১। কর্পোরেট মানসিকতা একটি প্রধান দায় এখানে। বাংলাদেশের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে নজর দিলে বুঝা যাবে যেগুলো সরাসরি মালিক পক্ষ কর্পোরেট টার্গেট নিয়েই মাঠে নামা। যার কারণে প্রফিট ম্যাক্সিমাইজেশনের একটি বিশাল চিন্তা তাদের মাথার উপর থাকে। তখন শিক্ষা হয়ে যায় পুঁজির বাজার। অনেকটাই মুক্ত বাজারে রূপ নেয়।নোয়াম চমস্কির ধারণা মতে, যে এতো টাকা যে সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিচ্ছে তা অবান্তর এবং অস্বাভাবিক, সে অর্থগুলো দিয়ে গরীব দুস্থদের ভালো শিক্ষা দেওয়া যেত। এই অসুস্থ প্রতিযোগীতায় আমাদের আন্দোলন মোটেও কাজের নয়, কারণ আমরাও অসুস্থ দৌড়ে নেমেছি উপযোগবাদের সর্বোচ্চ সুযোগ হাসিল করবার উদ্দেশ্যে।

২।আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকট আরেকটি প্রধান দায়। আধুনিক মতের মানে হলো বোলোনিয়া এবং প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেলকে যৌথভাবে ব্যবহার করে জ্ঞানের আসল মূল্য তুলে ধরা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সবসময় এ কাজ করে না, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাদ দিলেও অনেক সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেকে বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে পড়তে পারলেও শিক্ষার্থীরা তাদের আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে সরাসরি অজ্ঞ। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার এই রাষ্ট্রটিতে সরকারের ফান্ডিং এর পরিমাণও কম রিসার্চের ক্ষেত্রে। কারণ সরকার বিশ্বাস করে নিজেদের আয় বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া হলো সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাজ। আসলে বিশ্ববিদ্যালয় মোটেও এমন কোনো সংগঠন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আদি দর্শন সম্রাট শার্লমাইন থেকে শুরু করে উক্ত যতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি হয়েছে সবগুলো ছিল রাজা,প্রজা গির্জা ও রাষ্ট্রের দ্বারা চালিত। ফিনল্যান্ড,জার্মানি,ফ্রান্স এখনও বিশ্বাস করে যতো বেশি শিক্ষিত জাতি (উইথ ডাইভারসিফিকেশনাল কোর্স ) সে রাষ্ট্র ততোবেশি সমৃদ্ধশালী। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে উলটো, যদিও সরকার চাইলেই এই সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারে। জাফর ইকবাল সারের একটি তথ্যমতে খেয়াল করলাম ঢাবিতেই নাকি একজন ভিসি ৩০ কোটি টাকা আত্নসাৎ করেছে। এই যদি হয় তাহলে জ্ঞানের মূল্য থাকবেই বা কেন!

৩।যে সময়টি হাইডেল্বার্গ,কেমব্রিজ,অক্সফোর্ড,গ্রাগ,ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয় গণতন্ত্রের চর্চা এবং পরিপূর্ণ শিখার জন্য শিক্ষা চর্চা করতো সেখানে আমাদের দেশে আমরা মুখস্ত করিই নাম্বারের জন্য। দোষ তো শুধু একার বিশ্ববিদ্যালয়েরই নয়, সাথে আপনারও। আবার এই ধারায় আপনি পড়েন সেই ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বের হওয়া উচ্চতর চিকিৎসাবিজ্ঞানী,দার্শনিক,অর্থনীতিবিদ ইত্যাদি মানুষের চিন্তা এবং লেখাকে। আমাদের দেশে সে বিষয়ে মোটেও রাষ্ট্রীয়ভাবে কনসার্ন না এ বিষয়ে বরং তারা অন্য প্রান্তের মানুষের দেওয়া চিন্তাকে পড়তে খুবই ভালোবাসে, দাসত্বকে অনেকটাই পরোক্ষভাবেই গ্রহণ করে নিয়েছে। আবার এ নিয়েও আমাদের ছাত্র ছাত্রীও সচেতন না সমগ্রতার শিক্ষাব্যবস্থাপনা নিয়ে। এখানে একটি মেজর গ্রুপের টার্গেট খেয়ে পড়ে বাচা কিন্তু জ্ঞান কাউকে খেয়ে পড়ে বাচায় না, উলটো খাবার দেয় আর সম্মান দেয়।



৪। সবচেয়ে বর সমস্যা হলো শিক্ষার উপাদান এবং শিক্ষা জিনিসটিই বা আসলে কি তাৎপর্য বহন করে এটি রাষ্ট্র হিসেবে সকলকে বুঝিয়ে একতাবদ্ধ করবার দায়িত্ব রাখে। প্রশাসন এক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করবে অবশ্যই এবং সাথে একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরও উচিত এ বিষয়ে তার জ্ঞান আহরণ করা। একটি জাতি সামগ্রিকভাবে তখনই একতাবদ্ধ যখন সে তিনটি বিষয় নিয়ে অধ্যয়ন করতে সক্ষম হবে,এন্টোনিও গ্রামসির মতানুসারে- ভাষা,লোকসাহিত্য ও লোকইতিহাস,রাষ্ট্র দর্শন ও ইতিহাস। আর এই দায়িত্ব পালনে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে বিদ্যালয়-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ আমাদের বিদ্যালয় এবং কলেজ গোড়া থেকেই কর্পোরেট এক মুখী চিন্তাভাবনা ইনজেক্ট করিয়ে দেওয়ার ফলে শিক্ষার্থীরা আর উক্ত তিনটি সম্পর্কে সচেতন থাকে না যার অন্তীম ফলাফল রাষ্ট্রকে নিয়ে সন্দিহান,অজ্ঞতা ইত্যাদি। এগুলো একটি দেশে বড় ধরণের ব্যাকফায়ার করে। যেমন জার্মানি,জাপান,চায়না ,ইরান এর ক্ষেত্রে লক্ষ্য করুন। তারা কালচারালি বেশ স্ট্রং এবং তাদের সিলেবাস দেখলেই বুঝে উঠা সম্ভব তারা আগে নিজের মূলকে সকলের সামনে পেশ করে তার পর ভিন্ন রিলেটেড পড়ালেখায় তাকে অর্ন্তভুক্ত করে। এতে করে একজন ছাত্রজীবনে তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাজসচেতন করে তুলে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে উলটো। আমরা জানিই না বাংলাদেশের স্বাধীনতা বা বিজয় দিবস কবে, তাহলে রাষ্ট্রীয় কোনো আর্জেন্সিতে আমরা কি কোনো ভূমিকা স্ট্রংলি রাখতে পারবো?

৫। সমগ্রতার এবং বিচিত্রতার উপর যখন কোনো ব্যক্তির জ্ঞান থাকে না তখন সে কোনো একটি জ্ঞানের জগত বা ফ্যাকাল্টির উপর সবচেয়ে বেশি দূর্বল এবং অজ্ঞ হয়ে পড়ে। এই অজ্ঞতয়ার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে সবচেয়ে সন্দেহপ্রবণতা, ভুল চিন্তাভাবনা, অগঠনমূলক সিদ্ধান্ত এবং ভাবনা চিন্তাকে গ্রহণ করে নেয় যার ফলে সমাজে একটি চরম দ্বিধাদ্বন্দের সৃষ্টি হয়, একে অপরকে ভুল বুঝে উঠে ইত্যাদি। যেমন আমার দেখা অনেক মানুষের ইতিহাসের চর্চা ধরতে গেলে একেবারেই নেই অথচ কথা বলবার সময় অনিয়মতান্ত্রিকভাবেই এই ভুল শোনা ইতিহাসের আশ্রয় নিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে থাকে। এভাবে একটি দেশ এর মেরুদন্ড নষ্টই হয় পড়ে শুধুমাত্র চর্চার অভাবে। 


৬। সাংস্কৃতিকভাবে আমাদের রাষ্ট্র এখনও অনেক দূর্বল কারণ আমরা প্রত্যক্ষভাবে সেগুলো চর্চা করি না। এর কিছু কারণ ও রয়েছে যেমন দেশপ্রেমের অভাববোধ একটি, কারেক্টনেসের চিন্তাভাবনা থেকে মুক্ত থাকে, গণতন্ত্র বা নিজ ঐতিহ্যগত কালেক্টিভ কালচারের উপর সচেতনতা নেই ইত্যাদি। কোনটা সঠিক আর কোনটা ভুল এই ডিসিশন মেক করতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে মারাত্নক হিমশিমখেতে হয় বা হবে।


 ৭। শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা আসলেও জানি না যে আমাদের আসলে কি করতে হবে? কেন আমাদের জন্য এই প্রতিষ্ঠানটি নির্মিত হয়েছে, কি এর দায়িত্ব কর্তব্য। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ও আমাদের মানতে বাধ্য করেনি যে বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান নির্মাণের কারখানা বরং পরোক্ষ উক্তিতে বারে বারে লিপ্সা আর নষ্ট প্রতিযোগিতায় ঠেলে দিয়েছে আর এই স্রোতে আমরাও গা ভাসিয়ে চলি। এরিস্টটলের যুগেও পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক নষ্ট রাজনীতিকে ধুলামাখা করে ছাড়তেন। আন্দোলন হবে প্রগতির প্রতীক যা পরিবর্তন সাধিত করবে। আর আমরা পরিবর্তনকে ভয় পাই, আমরা গুটিয়ে চলি, যা সামনে তাই গিলে খাওয়িয়ে দিবে আর আমরা খাবো। এ হলো আমাদের অবস্থা অথচ বিশ্ববিদ্যালয় আরেক অর্থে হলো ছাত্রগিল্ড! গণতন্ত্রের গিল্ড, পরিবর্তনের গিল্ড!

   সামগ্রিকভাবে আমরা এখনও জাতি হিসেবে বিবেকবান নই, নই আমরা আসল অর্থে শিক্ষিত। যে শিক্ষা এখনও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে কিন্তু আমরা তো নামে গন্ধে অর্থের পূজারি বৈকি কিন্তু গাল মন্দ করবার সময় ঠিকই করবো। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রকৃত অর্থে নই, আসলেই নয় কি? 





Comments

Popular posts from this blog

পোস্ট মর্ডানিজম :ভাবনাচিন্তা ও তত্ত্ব

মিশেল ফুকোঃ জ্ঞান,শৃঙ্খলা এবং ক্ষমতা

১৯ শতকে বাংলায় সমাজ সংস্করণ এবং ধর্ম সংস্কার