পোস্ট মর্ডানিজম :ভাবনাচিন্তা ও তত্ত্ব
পৃথিবীর
চিত্র এবং চরিত্রায়ন প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে সমাজ ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা,
সামাজিক প্রেক্ষাপট, রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও গতি এমনকি দার্শনিক পর্যালোচনা। প্রতিনিয়ত
পরিবর্তনের ছোঁয়া এই বিশ্বের বুকে ঘটেই চলেছে। বিশ শতকের শেষ তিন দশকে এই ভাবকল্পটি
প্রতীচ্যে শিল্প ও তত্ত্বের প্রতিটি স্তরকে প্রভাবিত করেছে। কিছু ক্ষেত্রে রূপান্তরিত
করেছে আবার কিছু ক্ষেত্রে পরিমার্জিতও করেছে। এই আলোড়নকৃত ধারাটির নাম পোস্ট মর্ডানিজম বা উত্তর আধুনিকতাবাদ।
পোস্ট মর্ডানিজম
,পোস্ট মর্ডানিটি এই শব্দগুলো ব্যাপক অর্থে জটিল। আমরা প্রায় সময় উচ্চারণ করি ভাবগত
জায়গা, আসলে তার মূল অর্থ হলো এই শব্দগুলো অভ্যন্তরীণ সামগ্রিক চিন্তাভাবনা, পরিসর,
প্রভাব, বৈশিষ্ঠ্য ইত্যাদি সামগ্রিক বিষয়াদি। এই বিষয়গত অধ্যায়টি রাজনীতি, অর্থনীতি,সামাজিক
ব্যবস্থাপনা,আর্থ সামাজিক ব্যবস্থাপনা, শিল্প, সাহিত্য,দর্শন,চিত্রকলা জুড়ে ব্যাপক
প্রভাব বিস্তার লাভ করেছে।
তবে এখন
থেকেই প্রাথমিক ভাবে শুরু করা যাক এর বিষয়াদি নিয়েঃ আসলেই এটি কি এবং কেন আর কিভাবে?
বিখ্যাত
পোস্ট মর্ডার্ণ সাহিত্যিক ও তাত্ত্বিক জন বার্থ লিখেছেন,
“A principal
Critics…writing in post modernist journals or speaking at post modernist
symposia,consists in disagreeing about what post modernism is or ought to be”
লক্ষ্য
করার জন্য একটি বিষয় জানানো প্রথমত জরুরি সেটা হলো এটিকে আরেকটু বিশ্লেষণ করবার প্রয়োজন
উক্ত সংজ্ঞাকে। খেয়াল করুন “Disagreeing”শব্দটি। যার মূল আরো নির্ধারণ করলে আসবে মতানৈক্য বা দ্বিমত। “পোস্ট মর্ডানিজম” শব্দটিকে
সংজ্ঞায়িত করাটাই খুব কঠিন ব্যাপার। পোস্টমর্ডানিস্ট, যা সংস্কৃতিতে বিদ্যমান তা
নিয়ে মূল ধারায় গবেষণা করেন এবং কোনো বিষয়বস্তুকে পুনরায় ভাবনা চিন্তা করে কোনো
একটি ভিত্তি স্থাপনের চেষ্টা করেন। এর জন্য তাদের কিছু ধারণা বা ভিত্তিকে কেন্দ্র
করে সেই অবস্থান গড়ে তুলতে হয়। সেগুলো হলোঃ- পার্থিব বিষয়াদির ব্যাখ্যা, অভিজ্ঞতা,
প্রসঙ্গ/নির্দেশক, অগ্রগতি বা প্রগতি। সুতরাং এই ধারণাগুলো মিলে একটি নান্দনিক এবং
সাংস্কৃতিক পণ্য বা বিষয়ের সৃষ্টি হয় যার জন্য এবং যাকে বুঝবার জন্যে পোস্ট মর্ডান
চোখ হওয়া উচিত।
এই শব্দ এবং তার ব্যবহার ঐতিহাসিকভাবে বেশ সমৃদ্ধ। অনেক ক্ষেত্রে তা
গ্রহণযোগ্য ও প্রভাবশালী ছিল। ১৮৭০ সালে ইংরেজ চিত্রশিল্পী জন ওয়াটকিনস চ্যাপম্যান
ফরাসি ইম্প্রেসনিজম শিল্পের থেকে অগ্রণী শিল্পকে যাকে ফরাসী ভাষায় বলা হয় (আভা গার্দ
) পোস্ট মর্ডান চিত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আপনাদের বুঝার সুবিধার্থে বলে রাখা
ভালো ফরাসী ইম্প্রেসনিজম বিষয়টি আসলে কি সহজ ভাষায়। পৃথিবীতে রেনেসাঁর শুরু কাল থেকে
এখন অবধি শুধুমাত্র চিত্রকলায় একাধিক দার্শনিক ও মনস্তাত্ত্বিক আন্দোলনের সৃষ্টি
হয়েছে। এর মধ্যে ফরাসী দেশে উনিশ শতকে বিখ্যাত সেই আন্দোলনটির নাম ইম্প্রেসনিজম।
যার মূল ভাব ও দর্শন হলো প্রাকৃতিক আলোর ব্রাশের দ্বারা যথাযত ব্যবহার,আলোর সঠিক
চিত্রায়ন। একটি সাধারণ বিষয়বস্তুকে যেন মানুষ তার চোখ দিয়ে আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ
করতে পারে সেই ক্ষমতার সৃষ্টি। রঙের ব্যবহার এবং তার স্ট্রোকগুলো যেন নজর কেড়ে নেবার
মতো হয়।
অপরপক্ষে জার্মানের এক বইতে এই শব্দটি ব্যবহার করে তাকে বলা হয়েছে ইউরোপের সংস্কৃতিতে
উদ্ভূত নতুন ভাষা হিসেবে যাকে আবার ফ্যাসিস্ট মানসিকতা বলা হয়েছে। উপরে আমি যে
একটি শব্দ ব্যবহার করেছিলাম দ্বিমত বা মতানৈক্য। এই শব্দের কারণে তার পেছনে একটি ফ্যাসিস্ট ট্যাগ
বসানো হয়েছে। আবার অপরদিক আমি এও বলেছিলাম একে সংজ্ঞায়ন করাটা নিতান্তই কঠিন ব্যাপার,
কারণ এর অপর পৃষ্ঠায় আরেকটি অর্থ জড়িত। এই অর্থের সৃষ্টির জন্য একটি স্তরকে নিয়ে কাজ
করতে হয়। যা হলো “মানবকেন্দ্রিকতা” “মানবতাবাদ” এবং “আলোরমুখী”। প্রসঙ্গতই বেল এর কাছে
পোস্টমর্ডানিজম হচ্ছে এমন এক ধর্ম্ প্রাণ মানুষ যে আধুনিক যাবতীয় রাজনৈতিক পথকে বাতিল
করে দিয়েছে।
অন্যদিকে পোস্ট মর্ডানিজমকে বলা হচ্ছে সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে একটি বিস্তর সংশয়বাদ। যা পরবর্তীতে "সাব্জেক্টিভিটি" এর সৃষ্টি করে, আপেক্ষিকতার জন্ম দেয়। জাক দেরিদা যখন সবে নতুন অবয়ববাদের গঠন করলেন তখন তিনি বলছেন ভাষা তোমাকে যে অর্থ দেয়,সেটা নিছক আপাত অর্থ,খাটি অর্থ নয়। উত্তর আধুনিকতায় বাস্তব ও সত্যের যে ধারণা তাতে বলা হয় যে, এই দুই আমাদের আয়ত্ত্বের বাহিরে,কিংবা সে সব আমাদের আয়ত্ত্ব করতে দেওয়া হয় না। দেরিদার তত্ত্বকে পুষ্ট করেছেন পোস্ট মর্ডানিস্টরা।
অন্যদিকে পোস্ট মর্ডানিজমকে বলা হচ্ছে সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে একটি বিস্তর সংশয়বাদ। যা পরবর্তীতে "সাব্জেক্টিভিটি" এর সৃষ্টি করে, আপেক্ষিকতার জন্ম দেয়। জাক দেরিদা যখন সবে নতুন অবয়ববাদের গঠন করলেন তখন তিনি বলছেন ভাষা তোমাকে যে অর্থ দেয়,সেটা নিছক আপাত অর্থ,খাটি অর্থ নয়। উত্তর আধুনিকতায় বাস্তব ও সত্যের যে ধারণা তাতে বলা হয় যে, এই দুই আমাদের আয়ত্ত্বের বাহিরে,কিংবা সে সব আমাদের আয়ত্ত্ব করতে দেওয়া হয় না। দেরিদার তত্ত্বকে পুষ্ট করেছেন পোস্ট মর্ডানিস্টরা।
এর বাহিরেও
আরো বৈশিষ্ঠ্যসূচক আলোচনা রয়েছে একে ঘিরে তা আমরা বিস্তারিত জানবো। তার আগেই জেনে নেওয়া
প্রয়োজন পাশ্চাত্য ইতিহাসের সময়কালগুলো। আবার এটাও জেনে নেওয়া উচিত উত্তরাধুনিকতাবাদের
আগের সময়কাল হলো আধুনিকতা এবং আধুনিকতাবাদ,যার চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্য জেনে নেওয়া অত্যন্ত
জরুরি।
পাশ্চাত্য
ইতিহাসকে মূলত চারটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়-
১। ৬৭৫-১০৭৫
হচ্ছে ওয়েস্টার্ণ ১ (অন্ধকার যুগ)
২। ১০৭৫-১৪৭৫
ওয়েস্টার্ণ ২ (মধ্যযুগ)
৩। ১৪৭৫-১৮৭৫
ওয়েস্টার্ন ৩ (আধুনিক)
৪। ১৮৭৫
থেকে ওয়েস্টার্ন ৪ যাকে বলা হয় পোস্ট মর্ডান যুগ।
![]() |
পোস্ট মর্ডান স্কাল্পচারের নিদর্শন |
![]() |
পোস্ট মর্ডান আর্ট |
উত্তর আধুনিকতাবাদ কে কাল পরম্পরায় কোনো একটি পর্যায়ের সাথে যুক্ত করে দেখা
উচিত নয়, বরং একে প্রতিটি কালপর্বেই উপস্থিত একটি রচনা প্রবণতা হিসেবেই গ্রহণ করা
উচিত। এই ব্যাখ্যা বৈচিত্র্য এবং বহু পারস্পরিক বিপ্রতীপ পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। তাই
বলা হয় উত্তর আধুনিক চিন্তাভাবনা প্রতিটি বস্তু ও চিনাত্র মধ্যে নিহিত। এটাকে
অনেকেই বলেন নাটকীয় সংঘাত, যা মর্ডানিজম বা আধুনিকতাবাদকে চ্যালেঞ্জও করে।
পোস্ট মর্ডানিজম বৈশিষ্ঠ্যের আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে অনির্ণেয়তা, আপেক্ষিকতা,
সংকর বিষয়াদি এবং মহাআখ্যানের প্রতি বিরূপতা। মহাআখ্যান বলতে এমন সব তত্ত্বকে যা
জীবন-শিল্প-ইতিহাসের সার্বিক ব্যাখ্যা হিসেবে কার্যকরী হতে চায়। এর বিপরীতে নানা ধরনের
ছোট ছোট আখ্যানের উপস্থিতি বিদ্যমান। এইসব ছোট আখ্যান ঘটনা বা বিষয়ের স্থানীয় ব্যাখ্যা
যা স্থান-কাল-পাত্রের স্থানিক ভঙ্গিমাকে ছাপিয়ে সার্বিক বা সর্বজন হয়ে উঠতে চায়
না। এমনকি বিভিন্ন আখ্যানের মধ্যকার যৌক্তিক বিশ্লেষণের জন্য, বৈধতা বিচারের জন্য,বৃহত্তর
কোনো ভিত্তির সম্ভাবনাও অস্বীকৃত এই পরিস্থিতিতে। এই চরম আপেক্ষিকতাই উত্তর আধুনিকতার
জ্ঞানতত্ত্বের আত্যান্তিক বৈশিষ্ঠ্য হয়ে উঠেছে। বাস্তব এবং তার অনুকৃতির মধ্যকার
পার্থক্য দীর্ঘদিন মানা হয়েছে,তার বিলুপ্তি কে পোস্ট মর্ডান সময়ের আর একটি বৈশিষ্ঠ্য
হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বিখ্যাত দার্শনিক বদ্রিলার কাছে এ বিষয়টি আবার
বাস্তবেরও উর্ধ্বে অতিবাস্তবতার ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। তার মতে, ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের
বিজ্ঞাপন ও তার সর্বব্যাপ্তি আমাদের মধ্যে একটি আলাদা বাস্তববাদের জগত সৃষ্টি করে
দিচ্ছে এবং তার ফলে মানসিক জগতে একটি আকার ও প্রতিকৃতির সৃষ্টি হয় যা নিতান্তই
গণমাধ্যম কেন্দ্রিক বাস্তবতা। এই ক্ষেত্রে বর্তমান জগতে পোস্ট মর্ডানিজমের একটি
সবচেয়ে বড় সংজ্ঞায়ন হলো –
“Technoloy can give us more Reality
than nature”
জেমসন দেখিয়েছেন
যে, বাহ্যিক রূপ ও অন্তর্গত মূল্য বা তাৎপর্য এর সম্পর্কে ‘বিশ্বাস’ বিশ শতকে পাশ্চাত্য
চিন্তাজগতে প্রভাবশালী হয়ে দাড়িয়েছে। মনোবিশ্লেষণ,মার্ক্সবাদ,অস্তিত্ববাদ,চিহ্নতত্ত্ব-প্রতিটি
স্থানই দাঁড়িয়ে আছে ভিত্তি ও বর্হিঃপ্রকাশের উপস্থিতি মেনে,তাদের মধ্যকার সম্পর্কের
উন্মোচন ও সম্ভাবনায় বিশ্বাসের নির্ভরে।
অপরদিকে
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হতে থাকে সেই সময় হতেই রাজনীতি
জটিল আকার ধারণ করতে থাকে। জাতিসংঘের উত্থান, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর গঠন, আন্তর্জাতিক
আইন ও সংস্থা, বহুজাতিক সংগঠন,চুক্তি ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ঠিক সেই সময়েই উত্তর
আধুনিকতাবাদ এই জটিল রাজনীতির মধ্যে মিশে যায়। পোস্ট মর্ডানিজমের একটি প্রভাব হিউম্যানিজমের
ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তার করে যার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর “ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান
রাইটস”এর মতো নীতিগুলোকে গ্রহণ করা হয়। আধুনিকতাবাদের
অনেক বিশ্বাস ,ধারণা ও নীতিকে চ্যালেঞ্জ করে বসে এবং তার প্রভাব বিস্তারগুলোকে নির্দেশিত
করে রাখে আর্ট ও আর্কিটেকচারে, থিয়েটার ও শিল্পে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক
চিন্তাভাবনার মধ্যে।
অনির্ণেয়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যৌক্তিকতা এবং যুক্তিহীনতার যে বিভাজন
আমাদের সিদ্ধান্তকে নিয়ন্ত্রণ করে পোস্ট মর্ডান ভাবনায় এই বিভাজনকে লুপ্ত করে
দেওয়া হয়। ফলে যেকোনো তাৎপর্যের বোধ,যে কোনো ধারণা ও নিশ্চিত অনির্ণীত হয়ে থাকে;
স্থান কাল পাত্রর যৌক্তিক পারম্পর্যের ফাটল তৈরি করা হয়। নন্দন তত্ত্বে বা
নান্দনিকতায় পোস্ট মর্ডানের অন্যতম ভিত্তি আপেক্ষিকতা,বাস্তব এবং অনুকৃতির
বিভেদলুপ্তি, স্থান কাল সত্তার পারম্পর্য-রিক্ততা,অনির্ণেয়তা। অর্থাৎ পোস্ট মর্ডানিজন
পার্থক্য নামক শব্দটিকে ভেঙে ফেলে দেয়। এখানেই সবচেয়ে অসাধারণ ব্যাপার ঘটে, পোস্ট
মর্ডান সাহিত্য গুলোর বিশেষ বইগুলোকে যখন পড়া হয় প্রতিবারই যেন মনে হয় আখ্যান পূর্ণ
নয়, প্রতিবারই পাঠক হিসেবে মনে হবে যেন সবে নতুন চরিত্র ও ঘটনাযুক্ত একটি আখ্যান শুরু
করেছেন। একটি পূর্ণাঙ্গ এককে রূপ নেয় না। একটা জায়গায় থাকে আবার নতুন করে আরেক অধ্যায়ের
সূত্রপাত। অনেক সাহিত্যে দেখা যায় বাক্যাংশে যে ধরনের শব্দ ব্যবহার করা হয় তার অর্থসম্ভাবনাকেও
নষ্ট করে দেয়, পরিবর্তন করে দেয়, আলাদা কিছু উপস্থাপন করিয়ে দেয়। এর কারণ পোস্ট মর্ডান
অনির্ণেয়তার সন্ধানী। বলা হয়, পোস্ট মর্ডান এমনই একটি অধ্যায় যেখানে একটি কাঠামোকে
সামনে রাখা হয় যা মূলত “Unrepresentable” যা
বয়কট করে তার নিজের আসল রূপ বা অস্তিত্ব। যেই অর্থ মর্ডানিস্ট পৃথিবীতে গঠিত হয়
একটি ‘ঐক্য’ নিয়ে, এই ঐক্য কে সরাসরি বয়কট করেন পোস্ট মর্ডানিস্টরা। আপেক্ষিকতার প্রয়োজনীয় আলোচনা করতে গিয়ে অনেকেই দেখিয়েছেন সত্য,বাস্তব,যুক্তিবাদে বিশ্বাসী
মানুষের ইতিহাসে নিপীড়নের সহায়ক হয়েছে। “Age of enlightenment” এর সময় যেই রেনেসাঁর
কথা ছিল সত্য ও যুক্তির পথ দেখাবে সেটি বর্তমানে এসে একটি একক সত্য ও যুক্তির পথকে
উন্মোচন করেছে। ক্যাথারিনের ভাষায় বলতে গেলে বলা যায় পৃথিবীর এই অধ্যায় সমগ্র মানবজাতির
সাথে ধোকাবাজি করেছে। আধুনিকতাবাদের যুগে পা রাখবার পরও নিগ্র মানুষদের সামাজিক ও রাজনৈতিক
অঙ্গন থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া, বৈষম্যতার সৃষ্টি, নন ওয়েস্টার্ন মানুষ ও রাষ্ট্রের উপর
চাপ,নির্যাতন ও অমানবিকতা। সেখানে পোস্ট মর্ডানিজম কখনই একক কোনো সত্যের বা যুক্তির
সৃষ্টি করেনি বরং সে অপূর্ণ থেকে বিভিন্নতা বা ভিন্ন ধারার দৃষ্টিকোণের সৃষ্টি করে
গিয়েছে। তাই পোস্ট মর্ডানিজম আয়োজন করে বিভিন্ন ভঙ্গিমার ,কিন্তু এটি কখনই বৈষম্যকে
স্থান দেয়নি বরং বিচ্যুত করেছে কেন্দ্রীয় শক্তিকে। (যেমন বর্তমান আমেরিকার অবস্থানকে
চ্যালেঞ্জ করবার ক্ষমতা রাখে পোস্ট মর্ডান চিন্তাধারা)
পৃথিবীর যাবতীয় যেকোনো দেশেই যেকোনো পরিস্থিতিতে সামাজিক দ্বন্দসমূহকে নীতিগতভাবে
নিরসন করতে হলে প্রত্যেক জীবের নিজস্ব অবস্থানের জায়গা থেকে তাকে মুক্তি দিতে হবে,
প্রত্যক জীব সমান ও গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক এই জায়গাতে এসে পোস্ট মর্ডানিস্টরা বর্জন
করে এমন একটি ধারণা/চুক্তি/নীতিকে যা শুধুমাত্র একটি জাতি,বর্ণ, রাষ্ট্র বা লিঙ্গের
জন্যই শুধুমাত্র সুবিধাজনক অবস্থানের সৃষ্টি করবে। যেমনটি উপরেই আলোচনা করা হলো ইন্টারন্যাশনাল
হিউম্যান রাইটস নিয়ে। পশ্চিমা উদার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা যেভাবে পুরো বিশ্বকে
হাতের কাছাকাছি এনে দিয়েছে, ভবিষ্যতের চাকাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে, গঠন করেছে
চুক্তি ও নীতিগত অবস্থান, বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে উন্মুক্ত করেছে জগতকে ঠিক তার
উলটো পোস্ট মর্ডানিস্টরা বিশ্বাস করে এটি বরং সৃষ্টি করেছে দাসত্বের নতুন যুগ,
হস্তক্ষেপমূলক কার্যক্রম, মুখ বন্ধ করবার উপক্রম এবং সেই সাথে ধ্বংস করে দিচ্ছে
প্রথম নিজেরই আদি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি এবং তার উপজাতি ও আদিবাসীদের এবং একই সাথে
অন্যান্য জাতি ও রাষ্ট্রের মূল ধারাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। শুধুমাত্র একক নীতিতে পৃথিবী
আজ পশ্চিমা পন্থী বলে তাদের বাজারে তৃতীয়বিশ্বের মগজও ঢুকে পড়েছে, গ্রাস করে দিচ্ছে
সর্বস্ব।পোস্ট মর্ডানিস্টরা
বিশ্বাস করে, এই উদারনীতি, মুক্ত বাজার ,বাস্তবতাবাদ, বিশ্বজনীনতা এবং সামাজিক সাফল্য
নিজস্ব সংস্কৃতি দ্বারাই উপভোগ করা সম্ভব। এর জন্য কেন্দ্রীভূত শক্তির প্রয়োজন পড়ে
না। যেকোনো অ-পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে নাম দেওয়া হয় অনাধুনিক, আপাত দৃষ্টিতে সে মোটেও
অনাধুনিক নয়। এই অপাশ্চাত্যের ভিতরে সে প্রবেশ করায় সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের ভয়ানক
বিষবাষ্প যার পরিচালক স্বয়ং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরাই।
ভাবার্দশগত
বিচার করলে পোস্ট মর্ডানিজমের তত্ত্বের প্রান্তিক বর্গের মানুষের কথা ও ইতিহাসে তাদের
অবস্থানের কথা জানা যায় এবং সেই প্রবণতাও স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠে। ইতিহাসে যারা এতোদিন
জায়গা পায়নি,তাদের কথা বলার ঐতিহ্য প্রকাশিত হয় কার্ল ফিলিপসের লেখায় “ক্রসিং দ্যা
রিভার” বইতে।
বিখ্যাত
দার্শনিক লিওতারের ভাষায় এটি মূলত প্রতীচ্য ভাবনা। তিনি মনে করেন এটি “অতি উন্নত সমাজগুলির
জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে”। অন্য তাত্ত্বিকেরাও মূলত প্রতীচ্যের সামাজিক ও নান্দনিক
অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই পোস্ট মর্ডানকে অনুভব করেছেন। পাশ্চাত্য সমাজে চিহ্ন ও বাস্তবের
সম্পর্কের সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ ,বাস্তবের লুপ্তি ও চিহ্নের সর্বব্যাপ্তির কথা বলা হয়েছে।
উত্তর আধুনিকতা
শিল্পের উচ্চতা-নীচতার ভেদ স্বীকার করে না।এমনকি কোনটা শিল্প এবং কোনটা শিল্প নয় তার
তফাৎ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। শিল্পের একটা নিজস্ব টেস্ট আছে একেকজনের কাছে একেক
রকম। পোস্ট মর্ডান আর্টগুলোর তাই অর্থগুলোও নির্ভর করে কোনো ব্যক্তি নিজে কিভাবে বুঝে
নিচ্ছেন। পোস্ট মর্ডান স্বীকার করে এখানেই এই দেখার ভঙ্গিমা তার মধ্যে একটি অর্থের
সৃষ্টি করে যার মধ্যে একটি “quality”বিদ্যমান।
এদিকে আবার ইমানুয়েল কান্টের ভাষ্যমতে,
“Taste is formed by a continuous
assessment of quality.”
শিল্পীর
মৌলিক ‘সৃষ্টি’অংশ যদি সৃষ্টিশীল হয়,অভিনব অংশটি ফুটে উঠে ,সৃষ্টি সে কল্পনাকে যদি
সমৃদ্ধ করে, যেসব কল্পনা ‘না কল্পনা’ সেগুলোও সৃষ্টিকে সমৃদ্ধ করে, তবে সে সৃষ্টি পোস্ট
মর্ডানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আবার দেখা যায়,
চিত্রশিল্পের এক একটি ছবি যে একটি অনন্য ,স্বতন্ত্র শিল্পসৃষ্টি এবং টাকা দিয়ে ব্যক্তিগত
সম্পত্তি হিসেবে সেটি দখলে রাখতে পারে তারও বিরুদ্ধে রুখে দারায় পোস্ট মর্ডানিস্টেরা।
এই ঘরানার শিল্পীরা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় Authority এর প্রভুত্বকে বয়কট করে।
উত্তর আধুনিকতা
বিশ্বাস করে, শিল্পের একমাত্র কাজ হবে আত্ননির্দেশক, যা নিজের জন্য এবং তাকে ভাবাতে
বাধ্য করবে। সাহিত্য,আখ্যানকলা ও চলচ্চিত্রে কিছু বিমূর্ততার রূপ ধারণ করে, সেই আশ্রয়
নিয়ে গল্প বলবার ভঙ্গিমাকে সৃষ্টি করছে। বারবার তাকে জানাচ্ছে নির্দেশনা “আমাকে দেখো,শুধু
আমাকেই দেখো,আমার বাহিরে আর কিছুই নেই”। উত্তর আধুনিকেরা গল্প বলাতে প্রাচীন ঢং সম্পূর্ণ
বর্জন করেছে, ফলে সময় অনুসারে ঘটনাক্রম,বাস্তবতা,বিশ্বাস্যতার মাত্রা রক্ষা,যুক্তি ও ঔচিত্যের লক্ষণ বজায় রাখা কিছুই
আর স্বীকার করতে রাজি নন। স্বাভাবিক অর্থে বাহিরের বাস্তবকে আমাদের নানাভাবে প্রত্যক্ষ করার উপায় থাকলেও মনস্তত্ত্বের বাস্তব আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ নয়।পোস্টমর্ডান বাহির ও অন্তরের দুরকম সত্য বা বাস্তব নিয়েই প্রশ্ন তোলে ,প্রশ্ন তোলে সময় ও স্থানের ধারাবাহিকতা নিয়ে ,বাস্তবের সংগঠন সম্পর্কে।
(উপরের এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা ছিল মূলত পোস্ট মর্ডানিজমকে বুঝবার জন্য একটি প্রাথমিক
ধারণা। এছাড়াও আরো গভীরতর ও যৌক্তিক কিছু কাজ রয়েছে যার প্রকাশ আশা করি অন্য কোনো
সময় দিতে পারবো। কিছুদিন ধরে ভাবছিলা এই সম্পর্কে লিখবো কারণ আশেপাশে কিছু ধোয়াশা দেখতে পেয়েছি যার ফলে এই কন্সেপ্ট নিয়ে লিখা)
Comments
Post a Comment