আহমেদ ছফা: বাঙালী মুসলমানের মন এবং তার দর্শনচিন্তা।
“বাঙালী মুসলমান সমাজ স্বাধীনচিন্তাকেই সবচেয়ে বেশি ভয় করে। তার মনের আদিম সংস্কারগুলো কাটেনি।সে কিছুই গ্রহণ করে না মনের গভীরে। ভাসাভাসা ভাবে অনেক কিছুই জানার ভান করে,আসলে তার জানাশোনার পরিধি খুবই সংকুচিত।বাঙালী মুসলমানের মন এখনো একেবারে অপরিণত।সবচেয়ে মজার কথা,এ একথাটা ভুলে থাকার জন্যই সে প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে কসুর করে না। ” -আহমেদ ছফা।
আমরা বর্তমান সময়, অর্থাৎ ২১ শতকে দাঁড়িয়ে আহমেদ ছফাকে চিনিই না এমন কোনো ব্যক্তি পাওয়া সত্যি মুশকিলের কাজ। তার লিখা “গাভীবৃত্তান্ত”, “যদ্যাপি আমার গুরু”, “অলাতচক্র”, “অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী” ইত্যাদি বইগুলোর সাথে আমরা কম পরিচিত। জনসমাজের প্রতি স্তরের মানুষ এবং তরুণদের মধ্যে এই বইগুলো বেশ জনপ্রিয়। অনেকেই ভেবে থাকেন আহমেদ ছফা বুঝি শুধুই সাহিত্যিক বা কবি, এগুলো ছাড়া তার আর অন্য কোনো পরিচয় নেই। কিন্তু আসলে এই আহমেদ ছফা শুধু মাত্র কবি-সাহিত্যিকই যে ছিলেন তা মোটেও সত্য নয়। তিনি বাংলার ইতিহাসে একজন প্রখ্যাত ও বিখ্যাত দার্শনিকও ছিলেন একাধারে। ১৯ শতকের একজন বিখ্যাত বাঙালী দার্শনিক হিসেবে পরিচিত আহমেদ ছফা। এছাড়াও গ্যেটের “ফাউস্ট” কাব্যনাট্যের বঙ্গানুবাদ তার জীবনের অন্যতম কীর্তি।
আহমেদ ছফার জন্ম ১৯৪৩ সাল এবং মৃত্যু ২০০১ সালে। এই সময় তিনি পরিচিত ছিলেন কবি,সাহিত্যিক,বুদ্ধিজীবি,চিন্তাবিদ,লেখক। আহমেদ ছফার দার্শনিক যাত্রা শুরু হয় মূলত জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাকের হাত ধরেই ,বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথম তার এই ব্যক্তির সাথে পরিচয় ঘটে,যিনি তৎকালীন বাংলার বুকে শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। আহমেদ ছফাকে দাবী করা হয়ে থাকে, বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ-কাজীনজরুল-বঙ্কিমের পর বাংলা সাহিত্যে অনবদ্য চিন্তাশীল কোনো লেখক এবং চিন্তক।এমনকি বাংলা সাহিত্যের আরেক বুদ্ধিজীবী আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও স্বীকার করে নেন, তার গল্প বলা এবং সাহিত্য লেখার কলাকৌশল এতোটাই শক্তিশালী যে সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্রুত বিস্তার লাভ করতে পারেন।
১৯৮০ সালের পর আহমেদ ছফার চিন্তাশীল কর্মকান্ডের মাধ্যমে তিনি বাঙালী জাতির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস রচনা করেন। সেখানে তিনি বাঙালী জাতির দার্শনিক পর্যালোচনা, বাঙালী জাতির চিন্তা এবং কাজের মধ্যে সম্পর্ক ও বিন্যাস, বাঙালী জাতির পূর্ব ইতিহাসে সফলতা এবং ব্যর্থতার আলোচনা,এ জাতির ভবিষ্যৎ এবং দূরদর্শিতার চিত্র বেশ সফলতার সাথেই তুলে ধরেন। এ সময় তিনি নিজেকে বেশ শক্তিশালী দার্শনিক হিসেবে গড়ে তুলেন এবং বাঙালী জাতি সম্পর্কে একটি আলোচনা তুলে ধরেন ঠিক অন্য এবং ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যা আগে কোনো ব্যক্তি এই জাতির জন্য এমন করে ইতিহাস লিখে রাখেনি। ঠিক এমনই একটি বই যা গত কয়েকশ বছরে বাঙলা ভাষায় এমন বিশ্লেষণধর্মী লিখা কোনোদিনও সম্ভব হয়নি,চিন্তা করাও হয়নি, তা সম্ভব করে দিয়েছেন “বাঙালী মুসলমানের মন” বইটি লিখেই আহমেদ ছফা।
বাঙালী মুসলমানের মনঃ
এই ধরনের আলোচনার আগে আমাদের বুঝতে হবে যে, আহমেদ ছফা কিভাবে এই যাত্রায় এলেন এই ধরনের চিন্তা নিয়ে, কেনই বা এলেন? স্বাধীনতা যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে আহমেদ ছফাকে বেশ কয়েকবার বাংলা একাডেমীর স্কলার শীপের জন্য আবেদন করতে বললো তার বন্ধু বান্ধবগণ। তিনি তখনও মাস্টার্স পাশ করেননি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নিয়ে পড়াশুনা করেন এবং সেখান থেকে অন্য একটি সাবজেক্ট(পলিটিক্যাল সাইন্স) থেকে আলাদা করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন । মূলত তার চিন্তাধারা বেশ জটিল ছিল এবং বেশ প্রতিবাদী চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। বাংলা একাডেমীতে যখন তিনি স্কলারশিপের জন্য যান, তখন তিনি বেছে নেন একাডেমিক থিসিস পেপার হিসেবে বেছে নেন ১৮০০-১৮৫৮ সাল পর্যন্ত বাঙালী মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ও বিকাশ এবং পথপরিক্রমা। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে মনস্তাত্ত্বিক জগত বিকশিত হতে থাকে তার। বাংলার সমাজে বাঙালী জাতির মধ্যে ভাষাগত,অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক চিত্রগুলোকে নিয়ে তিনি গবেষণায় মেতে উঠেন। এর মাঝেই পরিচয় ঘটে জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাকের সাথে।
আহমেদ ছফা তার জীবদ্দশায় একটি জটিল চিন্তার উদ্ভব ঘটান “সাহিত্যে ও পুথিলেখার রাজনীতি” নিয়ে। ছফার দাবী এই ধরনের পুথিসমূহ যখন লিখা হতো তখন তার বিষয়বস্তুর উপর দৃষ্টিপাত যদি কেউ করে থাকে তবে দুটি বিশেষ বৈশিষ্ঠ্যের সন্ধান পাবে। প্রথমত, বাংলার ইতিহাসে যখন মুসলিম শাসন অধিষ্ঠিত হয় তখন থেকেই বেশ কিছু কাহিনী লেখকেরা এমন বার্তা প্রচার করে ব্যস্ত ছিল অথবা অনুপ্রাণিত ছিল যাদের প্রধান বিষয়বস্তুই থাকতো সেই সকল লেখনীতে কোনো এক মূল্যবোধের বা ধর্মের অভিব্যক্তি। “নায়ক” থাকতো তাদের প্রধান বিষয় বস্তু, নায়ককে সাজাতেন কল্পনার চিরশক্তিমান এক প্রাণী হিসেবে যা এই বাংলার ভূখন্ডের মানুষ কোনোদিন সরাসরি তাকে দেখেনি, না দেখেও তাকে যেন উপলব্ধি করা যায়। সেই নায়কের বিভিন্ন ধরনের ক্রিয়াকলাপ দেখানো হতো এবং সেই ক্রিয়াকলাপের কারণে সত্যধর্মের বিজয় হয়। বিভিন্ন ধরনের মনমালিন্য, উচ্চাকাঙ্ক্ষী চরিত্র যেন পুঁথিমালায় জড়িয়ে থাকতো। এ ধরনের পুথিলেখকরা প্রমাণ করতেন যে পরকালের স্বর্গ যেন তাদের জন্য একেবারেই অবধারিত, সুন্দরী নারী আপনা আপনিই এসে পড়ে, শত্রুদের উপর তাদের বিজয় অর্জন যেন এক নিত্যদিনকার স্বাভাবিক ব্যাপার ইত্যাদি। ফলশ্রুতিতে দেখা যায়, তাদের মধ্যে ধর্মকেন্দ্রিক এই সকল আলোচনায় দ্বিধা থাকা উচিত নয়, কারণ তাদের হাতে এমন নায়ক আছে যে নায়ক যেন এই ভূখন্ডের জাতির সবচেয়ে বড় অভিভাবক এবং গুরু। গুরু এসে মাঠ পাক সব সাফাই করে দিয়ে বিজয়ের মিছিল বের করবে। দ্বিতীয়ত, আরেকটু তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে ছফা মনে করেন, এই ধরনের সাহিত্যের বেশ বিকাশ সাধন ঘটা শুরু করে তুর্কী আক্রমণের পর থেকে। এই আক্রমণের পর আরেকটি নতুন সমাজের জন্ম নেওয়া শুরু করে, সেই সাথে এই পুরো সমাজের একাংশের মধ্যে এক নতুন চিন্তার জন্ম নেওয়া শুরু করে। ছফা বলছেন, সে সময়কার এই রচনা গুলো রচিত হয়েছে বিভিন্ন সংঘাত -দ্বন্দকে কেন্দ্র করে্এবং সকল ধরনের কমস্থায়ী-দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক ধারার ব্যাখ্যা করে। মূলত পুরোনো সমাজে বাংলার ইতিহাসের প্রথম পর্যায়ে এই ভূখন্ডে যখন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, চর্যাপদ, মহাভারত এর আবিষ্কার ও চর্চা ছিল সেগুলো যেন ১২০০ সালের পর একটি লম্বা সময় পেরিয়ে যাবার পর এই জাতি সেগুলোর মধ্যে একটা জড়তা অস্বাভাবিকভাবে টেনে ধরলো। বাংলার একেবারে আদি ভূখন্ডে যে সমাজের নায়ক খলনায়ক হিসেবে-রামচন্দ্র,লক্ষণ,সীতা,রাবণ,ভীম,অর্জুন,ভীষ্ম,শ্রীকৃষ্ণ,দ্রৌপদী পরিচিত ছিল এবং বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন সাহিত্যে তাদের শক্তি, তাদের উৎপত্তি নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা করতো সেটি আর গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে নি। ঠিক এই সময়টিতে এসে পটপরিবর্তনের সাথে নতুন সভ্যতার নতুন লেখকদের উত্থানের পর তারা এই ধরনের আদিকালের পুঁথিগত চর্চার ইতিহাস থেকে সরে, একটি অংশের বিশেষ শ্রেণির মানুষদের প্রতি আবেগপ্রবণ হওয়া শুরু করলো নতুন রচনায়। এই আবেগপ্রবণতা সবচেয়ে বেশি যে ধরনের মানুষের কাছে গিয়ে ঠেকেছে তারাই ছিলেন এই বাংলার ভূখন্ডে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া এবং অজ্ঞান জাতিদের মাঝে যাদের কাছে পৃথিবীর জ্ঞান তাদের মস্তিষ্কে তখনও গিয়ে ঠেকেনি এমনকি তারা সমাজে বেশ অসহায় শ্রেণি, অসচেতন চিন্তাভাবনা। এই জন্য এই পটপরিবর্তনে তখন সেই সমাজের মানুষজন এই নিত্য নতুন আবেগময়ী, শক্তিশালী নায়কের মাঝে এমনভাবেই নিজেকে স্থাপন করে দৃঢ়ভাবে যে তার এখন এই নতুন সমাজে নতুন নায়ক লাগবেই! চাই নতুন বীর এই সমাজের। যাদের জীবনকথা আলোচনা করে দুঃখে সান্তনা পাওয়া যায়, বিপদে ভরসা নিয়ে বসে থাকা যায়,যারা কল্পনায় এবং চিন্তায় তাদের আপনজন হয়ে থাকবে। এই লেখকেরা তখন পরিচিত করাতে থাকেন হাতেম তাই,রুস্তম,হামজা চরিত্রগুলোর সাথে। তখনও এই জাতিসমাজ জানতোই না তার আদি ইতিহাস কি, কি কি উপাদান আছে তার আদি ইতিহাসে। আহমেদ ছফা মনে করছেন এ যেন হুট করে উরে এসে জুড়ে বসে এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করে বসলো যেন তার কাছে এই সকল বিষয়াদি ছাড়া আর কোনো কিছুই মুখ্য নয়, জানাটাও যেন পাপ আর অলসের কাজ হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক এই নতুন ধারার জন্মের ফলে তা বিভিন্ন ভাবে মনোজগতেই শুধুমাত্র মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। এই জাতির কাছে যেন কর্মের চেয়ে মুখ্য হয়ে উঠলো লোকশ্রুতি- জনশ্রুতি এবং সেই পুথিলেখকদের বাণী যেন স্বর্গসমান সত্য। তখনই নিজের ইতিহাসকে ভুলে থেকে সে এমনভাবে ইতিহাসের চর্চার বাক ঘুরিয়ে দিল যার কারণে আজও বাঙালী জাতি বললেই আমরা মিশ্র জাতি হিসেবেই বিবেচনা করি। এই ভাষার নিজের কি আছে? সব তো ফারসি,আরবী,পর্তুগিজ,তুর্কী,উর্দু,হিন্দি থেকেই ধার করা। এই জাতির স্বকীয়তা তো সেদিন থেকেই পতন ঘটা শুরু করে দিয়েছে। ১২০০ সালের পর বখতিয়ার খিলজির যুদ্ধের পরবর্তী সময় থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত বাংলায় যেভাবে এইসকল বৈদেশিক লেখার মধ্যে ১২০০ সালের আগে বাংলার ইতিহাসের গোড়ার চর্চা পাওয়া যায় না, ঠিক তেমনি বাঙালী জাতির ইতিহাস চর্চায় নিজের স্বকীয়তা অন্যের কাছে বিলি করে দিতে গিয়ে নিজেকে ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে ফেলে যার কারণে অন্য সভ্যতা দ্বারা নিজেদের গোলাম বানিয়ে নিতে বেশি কষ্ট করতে হয়নি। এভাবে জাতি তার ইতিহাস হারাতে হারাতে এখন এসে তারা এক তৃতীয় সমাজ ব্যবস্থার সৃষ্টি করে ফেলেছে। সেটা হলো, পশ্চিমমুখী বা ইউরোপ মুখী হতে গিয়ে। এই সময় ধর্ম-পশ্চিমা সংস্কৃতি-নতুন ধারার শিক্ষা যেন ১৯০০ সালের পরে বাঙালী জণগনের মাঝে বেশ সংকটের জন্ম দিয়ে ফেলেছে। সেই সংকট হলো, আমাদের বাঙালিদের ইতিহাসটা কি?
আহমেদ ছফা এবার এসে দাবীটা এবার সুক্ষ্ণ জায়গায় করছেন, মূলত আমরা জাতি হিসেবে এতোটাই সহজ সরল এবং টুকটাক হালকা স্বার্থের ঘ্রাণ পেলেই আমরা সেখানে হুট করে লাফ দিয়ে চলে যেতে একটু দেরি করি না যার কারণে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে জাতির স্বকীয়তা হারিয়ে তারা এখন “বাঙালী মুসলমান” আকারে ধারণ করা শুরু করেছেন। “বাঙালী মুসলমান”শব্দটির একটি কঠিন তাৎপর্য রয়েছে এই নাম ধরে বলার পিছনে। কারণ এই জাতি একটা সময় এতোটাই ধর্ম প্রবণ এবং ধর্মের নায়কের আশ্রয় গ্রহণ করে জীবন যাপন করেছে তা সত্ত্বেও এরাই ইংরেজ শাসনামলের সময়কালে নিজেদেরকে ইংরেজ সংস্কৃতির সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে রেখে আধুনিক হবার লোভে মেতে উঠেছিল। বুঝি হালকা শরাব খেলে, হালকা নতুন জামা পড়লেই বড় লাট হওয়া যায়। বুঝি সাদা চামড়ার অধিকারী হলেই ইউরোপের মতো বড়সাহেব হওয়া যায়, শিক্ষিত হওয়া যায়। ব্যাস, গোলমাল পাকিয়ে দিলো আবার ইতিহাসে এই জাতি। আসলে এই বাংলার সবচেয়ে বড় সমস্যাই হয়ে গিয়েছিলো যে, সে অন্য সভ্যতা সংস্কৃতিকে এতোটাই নিজের ভাবতো যে কখনই নিজের উৎপত্তি বা বিকাশ সম্পর্কে সে একবারও ভেবে পড়ে বুঝে দেখেনি, প্রয়োজন বোধ করেনি বলে আমরা আজও তাদের সংস্কৃতির কাছে গোলাম।
মুসলমান সমাজের প্রতিষ্ঠা হবার পর থেকে তাদের মধ্যে নতুন চাহিদা এবং আকাঙ্ক্ষার জন্ম নেয়। ঠিক যাদের মাঝে এই চাহিদার জন্ম নেয় তাদের মধ্যেই এই সকল পুঁথিসাহিত্য গুলো ছিল সীমাবদ্ধ। এই শ্রেণীর লোকজনেরাই ছিল এই পুথির লেখক,পাঠক এবং জনগণ। তাদের বিদ্যাবুদ্ধি,সাংস্কৃতিক অগ্রগতি কেমন ছিল তা বোঝা যাবে তাদের লেখার স্টাইল, রীতিনীতি দেখেই। তারা আসলে সামাজিক বাস্তবতাকে তুলে ধরতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ ছিলেন। নিম্ন তর মানুষের সামাজিক বাস্তবতার দৃশ্য, তাদের দৈনন্দিন জীবন যাপন, তাদের জীবিকা নির্বাহ, গ্রাম বাংলার মাটির ভালোবাসা এবং দেশপ্রেম যেন অনুপস্থিত। তাদের সাথে লেখকের মন-চিন্তার সম্পর্ক অতোটা গভীর ছিল না। আর এই ধরনের পুথিলেখকদের বিষয়বস্তু থাকতো রাজসভার বিদ্যা।রাজসভার মার্জিত রুচি,বিলাসবহুল জীবনযাত্রার ধরনই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আলাওল সহ বহু কবির কাব্য-ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলো।আবার সেই কবিরাও ছিলেন আরবী-ফারসী-সংস্কৃতি ভাষায় পারদর্শী। তারা তখন আরবী-ফার্সি অঞ্চলের কাব্য বা কাহিনীকে তুলে এনে তাকে অনুবাদ করে রসসমৃদ্ধ ভাষায় প্রকাশ করতেন যেখানে এই জাতির মূল রক্ত,নাড়ি,মাটির সাথে সম্পর্কই ছিল না। এখানে সবচেয়ে বড় যোগ্যতার ঘাটতি হয়ে দাড়িয়েছে। কারণ এতে নিজের সাহিত্য বা কাহিনী রচনার নিজস্বতাবোধ বলতে আর কিছুই থাকে না, তখন এক পর্যায়ে এক অংশের বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী অনুকরণপ্রিয় অথবা নির্ভরশীলতার জন্ম নিয়ে থাকে, সাধারণ গোলাম সেজে বসে থাকতেই পছন্দ করে। এটা তাদের বিশ্বাস করাতে বাধ্য করেছে এভাবে থাকলে একদিন সুন্দর বধু পাওয়া যাবে,সুন্দর আলিশান বাঙলোয় রাজার হালে থাকা যাবে, চুপচাপ থেকে থেকে মরে যাওয়া উত্তম। কোনো কাজই না করে বাঙালীর এই অংশের মাঝে এতোতাই আল জন্ম দিয়েছে যে নির্ভরশীলতা নামক শব্দটাই যেন তাদের কাছে গুরু বা ঈশ্বর। আর এটিই পেরেছে আমাদের বাংলার মূল সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করতে অন্য সভ্যতা বা সংস্কৃতির দ্বারা।
যারা বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী কবি ছিলেন তাদের মধ্যে একটি জিনিসের ঘাটতি অত্যাধিক। সেটি হলো যেই ধর্ম তারা যেভাবে নায়ক আকারে উপস্থাপন করে মহিমান্বিত করার প্রচেষ্টা চালান, সেই ধরনের মানসিকতার কবিদের মধ্যে সেই ধর্মের জ্ঞান বলতে লোকমুখে শোনা জ্ঞান, সাধারণ বাণী এবং অগভীর চিন্তাধারা,আউলিয়া দরবেশের স্বারা অলৌকিক তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং এই ধরনের কবিদের ক্ষেত্রে আমরা যদি একটু খেয়াল করে দেখি তবে একটি সুক্ষ্ণ ধারা পাবো। সেটি হলো ধর্মকে প্রচার করবার উদ্দেশ্য যেমন তেমন ভাবে তারা গবেষণা বা মূলধারার প্রেক্ষাপটকে কখনই মূল্যায়ন না করে যেমন খুশি তেমন সাজো সেজে তাদের লিখা পুঁথি প্রকাশ করতেন।যার কারণে দেখা গিয়েছে আরবী-ফারসী মিলে মিশে একাকার হয়ে পাচমেশালী ইসলাম ধর্মের ঝাপসা ধারণা গুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে গিয়েছে। তিনটি উপাদান এসকল সাহিত্য-রীতিতে বেশ দূর্বল ছিল। প্রথমত, যে সামাজিক আদর্শটি তারা প্রচার করতে চাচ্ছিলেন সেই সম্বন্ধে সম্যক ধারণা বা বোধ ছিল না। দ্বিতীয়ত, যে সমাজে প্রচার করবেন তার সাংস্কৃতিক চেতনার মান কেমন তার গবেষণা ছিল না এবং তৃতীয়ত,পূর্বের শিল্প দর্শনের যে ধারাটি ছিল এই ধারাটিকে সামাজিক প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে সম্পূর্ণ নতুন একটি খাতে প্রবাহিত করার ক্ষমতা ছিল কিনা। এখানেই মুসলমান সমাজ বেশ বড় মাপে সাংস্কৃতিকভাবে দূষিত হওয়া শুরু করেছে, কাব্যসাধনায় নিয়োজিত এই মানুষেরা বেশিরভাগ সময় এই সকল বিষয়ের তোয়াক্কা না করায় তাদের মধ্যে এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার সংকটে ভোগা শুরু করে যেখান থেকে তারা সহজেই অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হবার একটি বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়।
মূলত বাঙালী মুসলমানেরা ইতিহাসের আদি থেকেই নির্যাতিত একটি মানবগোষ্ঠী। এই অঞ্চলে আর্য প্রভাব বিস্তৃত হবার পর থেকেই বর্ণাশ্রম প্রথা প্রবর্তিত হলো, তাদের হাতেই শিকার হয়েছিল অসহায় অবস্থায়। মনে রাখতে হবে, এই নিম্নবর্ণের হিন্দুরা এই ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে মানবিক মুক্তির জন্য তারা প্রথমে বৌদ্ধ এবং পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তৎকালীন ভারতে ইসলাম প্রচারের পিছনে মধ্যপ্রাচ্যের দরবেশদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাব বিদ্যমান ছিল। কিন্তু লোদী,খিলজি এবং চেঙ্গিস খানের বংশধরদের সাম্রাজ্য বিস্তারই যে ইসলাম ধর্ম প্রচারের মূল কারণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই পাঠান মোগলদের ইসলাম এবং আরবদের ইসলাম ঠিক এক বস্তু নয়, ছিল না। আব্বাসীয় খলিফাদের আমলে বাগদাদে,ফাতেমীয় খলীফাদের আমলে উত্তর আফ্রিকায় এবং উমাইয়া খলীফাদের স্পেনে যে জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা হয়েছিল তা ভারত বর্ষে কোনোদিনও শক্তিশালীভাবে প্রবেশাধিকার লাভ করেনি। অর্থাৎ এই ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তারের পেছনে শুধুমাত্র নিজেদের শক্তিকে স্থাপন করাই তাদের মূল লক্ষ্য ছিল এবং ধর্ম এখানে তাদের রক্তের সাথে প্রবাহিত হয়ে এসেছে শুধুমাত্র। মুসলমান বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকদের জ্ঞানের চর্চা এবং মুক্ত দর্শন চর্চা যেভাবে মুখ্য হয়ে উঠেছিল এবং যার কারণে তারা ইউরোপীয় রেনেসায় তাদের মুক্ত চর্চার ফলে যে অবদান রাখতে পেরেছিলো তা কখনই ভারতবর্ষে প্রবেশ করে তো নি, ওই জ্ঞান-বিজ্ঞানের দার্শনিক চর্চা কেমন,কিভাবে করতে হয় তা সম্পর্কে এই বঙ্গদেশে তৎকালীন সাম্রাজ্যবিস্তারকারী রাজার কোনো চিন্তাই ছিল না।"তার উপর বাঙালী মুসলমানের অধিকাংশই আদিম কৃষিভিত্তিক কৌম সমাজের লোক যাদের মানসিকতা আদিম সমাজের চিন্তাধারা ও রীতিনীতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ।" সমস্যাটি এবার দাড়িয়েছে এখানে, আমরা যদি খেয়াল করে থাকি তবে দেখতে পারবো ইংরেজ যুগ অর্থাৎ ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের পর আমরা এক প্রকার নতুন ধারার সংস্কৃতির আধিপত্য আমাদের উপর বিস্তার হতে দেখি, শুধুমাত্র আমাদের আদিম চিন্তাধারার প্রতি অন্ধ আনুগত্যের কারণে ।এটিই আরো সহজ করে দেয় ইংরেজদের জন্য নতুন করে রাজ্য বিস্তারে। নতুন ভাবে ইংরেজ শক্তি আগমনের পর এই বাঙালী মুসলমান মেনে নিয়েছে এবং বসে থেকে চুপচাপ তাদের শাসনকে মেনে নেয়। কারণ তখন এই জাতির হাতে এই অস্ত্রটি ছিল না যে কোন শক্তির কারণে তারা ইংরেজ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। শুধুমাত্র তিতুমীরের বিদ্রোহ এবং ওয়াহাবী আন্দোলনে কৃষক ছাড়া তখনকার সময়ে নতুন গঠিত উচুশ্রেণীর মুসলমানেরা যে সেটাকে মনে প্রাণে সমর্থন জানিয়েছিলেন তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আমাদের জ্ঞান চর্চাহীন এই মগজকে বেশ ভালোভাবে ইংরেজরা তাদের শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে ধোলাই করে আমাদেরকে আরেক নতুন যাত্রায় স্থাপন করিয়ে দেয়। যদি সেই শিক্ষার এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার রূপ একবার বাংলার জাতি জানতো তাহলে তাদের এতোগুলো সাম্রাজ্যের হাতে নিজেকে দাস-দাসী হয়ে চলা ফেরা করতে হতো না। ইউরোপীয় রেনেসাঁর সময় যখন সাধারণ মানুষের মাঝে যুক্তিবাদের চর্চার সম্প্রসারণ ঘটে, তারা মানুষের মুক্তির আন্দোলন ঘটান, ১৭৮৯-১৭৯৯ সাল নাগাদ যে ফরাসী বিপ্লব এনে দেয় মুক্তি ও যুক্তির চর্চার ইতিহাস তখন থেকে ব্রিটিশ শাসন শেষ হবার পরও বাঙ্গালী মুসলমান জানতোই না কেন তারা বিদ্রোহ করবে?যুক্তি ও মুক্তির চর্চা কি?
বাঙালী মুসলমান আজীবন এভাবে দাসত্বের মধ্যে ডুবে ছিল, তার স্বাধীনতা যেন তার কাছে অপরিচিত।
দুটো পোস্টই পড়লাম। দুই লাইন লিখে আপনাকে বাহবা দিব সেই সামর্থ্যও নাই, আত্মবিশ্বাসও নাই। খুবই ভালো লেগেছে - এইটুকু না জানালে মন উসখুস করছিল। এরকম মাসে অন্তত একটা করে প্রবন্ধ যদি লিখতেন তাহলে আপনার ভার্চুয়াল আঙিনায় এসে এসে ঢুঁ মেরে যেতাম। নিষ্কর্মা মরিচা পড়া মগজটায় শান দেয়া হোত।
ReplyDeleteবিভাগের ছোট ভাই।
অসাধারণ লিখেছ বন্ধু ।
ReplyDelete