প্লেটোর আদর্শরাষ্ট্রব্যবস্থা পদ্ধতি এবং শিক্ষাপদ্ধতি



প্লেটোর আদর্শরাষ্ট্রব্যবস্থা পদ্ধতি এবং শিক্ষাপদ্ধতি



দর্শনের ইতিহাসে সক্রেটিস এর পরবর্তী একজন  অতীব গুরুত্বপূর্নব্যক্তি এবং সেই সাথে সত্যানুসন্ধানী ও জ্ঞানানুশীল দার্শনিক যিনি ছিলেন তার নাম প্লেটো খ্রিষ্টপূর্ব ৪২৭ অব্দে তার জন্ম এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে প্লেটোর দর্শন জীবনে যে ব্যক্তিটির সর্বোচ্চ প্রভাব ছিল তিনি সক্রেটিস শৈশব থেকে ই সক্রেটিসের সাথে প্লেটোর পরিচয় এবং তার সক্রিয় প্রভাবেই তিনি হয়ে উঠেন জ্ঞান-সত্য-কল্যাণের পথিকপ্লেটোর দার্শনিক মতামতের প্রধান উপকরন ছিলশব্দ-বচন-সংলাপ কিছু কিছু জায়গা এতোই চমৎকার রচনাশৈলীর উপস্থিতি কিন্তু কোথাও কোথাও খুব দূর্বোধ্যতার রচিত বহু গ্রন্থ রয়েছে এবং প্লেটোর নামে মোট ছত্রিশটি গ্রন্থ প্রচলিত আছে। এগুলো একত্রে প্লেটোর “ডায়ালগ” নামে পরিচিত। এই ডায়ালগ থেকেই প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রচিন্তা এবং শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে একটি আলোচনা করা দরকার।

আদর্শরাষ্ট্রব্যবস্থাপদ্ধতি
প্রথমেই রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করার আগে বলে নেওয়া ভালো যে, প্লেটোর দর্শন চিন্তা এবং “ডায়ালগ” সমূহ ভাববাদ এর সাথে সম্পর্কযুক্ত, যার মানেই হলো প্লেটো একজন ভাববাদী দার্শনিক। এখন প্রশ্নটি হলো ভাববাদী দার্শনিক কি?
উত্তরটি এমন যে, বস্তু জগতের যতো কিছু আছে সব কিছুরই নিয়ন্ত্রক পরমাত্না যেটাকে আবার “the Supreme Soul” ও বলাহয় এই দলের দার্শনিকগণ এরমতেবস্তু এবং শক্তি দুটো ভিন্ন জিনিসআমাদের দেহে একটি অলৌকিক এবং অবস্তুগত সত্ত্বা বিদ্যমান


এর মানেই হলো সূক্ষ্ণ জায়গায় যেপ্লেটো পরমাত্নার ধারণাকে বিশ্বাস করেন বলে তিনি রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থাপনায় দার্শনিকদের এবং তাদের ন্যায়পরায়নতা-নীতিশাসন-সুব্যবস্থাপনার একটি স্থান করে দিয়েছেন প্লেটোর মতেএকটি আদর্শ রাষ্ট্রের শাসক হবেন দার্শনিকেরা উদ্ভট মনে হলেও কেন প্লেটো এই কথাটিই বলতে গেলেনতার দাবিবাস্তবজ্ঞানহীন,কল্পনা বিলাসী কোনো সাধারন দার্শনিক এর হাতে প্রসাশনিক দায়িত্ব পরলে জনদূর্ভোগ বেড়ে চলবে তাই তার মতে দার্শনিক হলেন তিনি যিনি বই পুস্তক মতবাদকে ছাড়িয়ে বাস্তবজ্ঞানকে উপলব্ধি ,বাস্তবজীবনেরসাথে মানুষকে মাঝে একটি অবিচ্ছেদ্যসম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে এবং চিন্তা ও কাজের মাঝে সমন্বয়সাধন ঘটাতে সক্ষম। প্লেটোর এই ধারনা থেকে একতি জিনিস পরিলক্ষিত এই যে, বাস্তব জ্ঞানযুক্ত দার্শনিকগণ বস্তুগত এবং অবস্তুগত এর মধ্যেবাস্তবস্তার আলোকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সংযোগ ঘটিয়ে সমাজের জনগণের মাঝে একটি চিত্র এবং বাস্তবতা তুলে ধরার দায়িত্ব দার্শনিকগণের যাতে ন্যায়পরতা-নীতিশাসনের ব্যবস্থাপনা হবে দার্শনিকদের রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি। যাতে রাষ্ট্রের জনগন একটি আদর্শ  ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠে এবং অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহ তাদের ভুল ত্রুটি বুঝে তারাও যেন সংশোধন হতে পারে।

প্লেটোর মতামতকে যদি একটু বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে তবে এই কথা বলা যায়, রাষ্ট্র বস্তুগত এবং পরমাত্না বা মানবাত্না হলো অবস্তুগত। তাই প্লেটো পরমাত্না বা মানবাত্নার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন,রাষ্ট্রের যেমন রয়েছে দার্শনিক,সামরিক ও অর্থনৈতিক- এ তিনটি দিক। মানবাত্নারও রয়েছে তিনটি দিকঃ- বুদ্ধিজাত(Rational),বীর্যজাত(spiritual),কামনাজাত(appetitive) রাষ্ট্রের ন্যায়পরতাযেমন রাষ্ট্রের তিন শ্রেনির নাগরিকদের সহযোগীতা ও সমঝোতার উপর প্রতিষ্ঠিত,ঠিক তেমনি ব্যক্তিগত অবস্থান সর্বদা ব্যক্তিগত ন্যায়পরতা ও অর্ন্তনিহিত মানবাত্নার পূর্ণ সমঝোতার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত” 



সুতরাং বিষয়টি খুবই স্পষ্ট এভাবে যেমানবাত্না বা পরমাত্নার ধারনাটি যেহেতু অর্ন্তগত মানব আত্নার শক্তিকে বুঝাচ্ছে তাই এই মানবাত্নার সকল আঙ্গিক কে নিয়ন্ত্রন করার জন্য রাষ্ট্রে বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন দার্শনিকদের উচিৎ ন্যায়পরতারনীতিশিক্ষা ও ব্যবস্থাপনার উত্তোলন ঘটানো যেন সকল নাগরিক একই শিকলে ন্যায়নীতির সাথে বাধা থাকে
প্লেটো তার রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রধারণার সাথে নাগরিক ধারনার একটি সম্পর্ক দেখান এবং তিনি এই নাগরিক সমাজকে তিন ভাগে ভাগ করেন-অভিভাবক,সৈনিক ও কারিগর প্লেটোর রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা সম্পর্কে এই তিনশ্রেণীর নাগরিকদের উদ্দেশ্যে বলেন,

নিজ নিজ কাজ নিষ্ঠার সাথে সম্পাদন করতে হবে আদর্শরাষ্ট্রের তিনশ্রেণির নাগরিকদেরএকের কাজ অন্যকে হস্তক্ষেপ না করে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে বলিষ্ঠ সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলা হবে তাদের লক্ষ্য”  

শিক্ষাপদ্ধতি
প্লেটোর শিক্ষা পদ্ধতির ধাপের চুড়ান্ত লক্ষ্য হলো- পরিষ্কার ও বাস্তবসম্মত দর্শনজ্ঞান এবং রাষ্ট্রীয়কল্যাণকামনা। এই দুইটি অর্থে উদ্বুদ্ধ হতে হবে সকল নাগরিককে। তাই প্লেটো এই পুরো চিত্রকে সম্পূর্ণ তিনটি অংশে ভাগ করেন। শিক্ষাগত,অর্থনৈতিক ও জৈবিক পরিকল্পনা।

প্লেটো প্রথমেই ব্যাখ্যা করেন কিভাবে তার আদর্শ রাষ্ট্রে শিক্ষাপদ্ধতির সঠিক এবং বাস্তবসম্মত ভাবে প্রয়োগ হবে। এটি বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সম্পূর্ণ বিপরীত ক্রম। তিনি শিক্ষাব্যবস্থাকেই দুই ভাগে ভাগ করেন যার একটি অংশ প্রাথমিক এবং অন্যটি হলো উচ্চতর। জন্ম থেকে বিশ বছর বয়স পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরে সকল নাগরিক শিক্ষার সুযোগ পাবেন। এই বিষয়বস্তুর মধ্যে দুইটি স্তর। একটি হল সংগীত এবং অপরটি ব্যায়াম।শিশুদের এমন গল্প-সংগীত এর শিক্ষা দেওয়া হবে যা তাদের মনে সৎ সাহস, গাম্ভীর্য,সংযম সৃষ্টি করতে সহায়তা করে। সংগীতের দর্শন প্লেটোর কাছে খুবই ব্যাপক কারণ তা আত্নার সাথে একটি মানবিকতার মিলন ঘটাতে পারে এবং তা খুবই কার্যকর বটে। যারা এই প্রাথমিক স্তরে টিকে যাবেন তাদের নিয়ে শুরু হবে উচ্চতর পর্যায়। এই পর্যায়ে একজন উপযুক্ত শাসক হিসেবে গরে তলার জন্য রাষ্ট্র সর্বদা কাজ করে যাবে। গণিত শাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞানশাস্ত্রে শিক্ষা লাভ করবে। বুদ্ধিগ্রাহ্য বা বুদ্ধির জগতে প্রবেশ এবং চিন্তাশক্তি চরম শিখরে পৌছিয়েনেবার জন্য গণিত শেখানো তার
শিক্ষাপদ্ধতির নৈতিক দায়িত্ব।


শাসক হিসেবে মনোনীত ব্যক্তিকে তারপর ত্রিশ বছর বয়সে দার্শনিক শিক্ষার জন্য নিযুক্ত করতে হবে। পাঁচ বছর এই শিক্ষা লাভ শেষেই তিনি যোগদান করবেন সামরিক প্রশিক্ষণে যাতে রাষ্ট্রের জাতি এবং জাতীয়তাকে বহিরাগত হামলা আক্রমণ থেকে একজন শাসক তার পূর্ণ জ্ঞান দিয়ে যেন রক্ষা করতে পারেন। সামরিক ছাড়াও সে যেকোনো সরকারি ব্যবস্থাপণায় জ্ঞান লাভ করতে পারেন। এই প্রশিক্ষণ চলবে ১৫ বছর। এই ১৫ টি বছরে তিনি আরো জ্ঞান লাভ করবেন জীবন সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা এবং দৃঢ়তা। পঞ্চাশ বছর বয়সে তিনি ভূষিত হবেন উচ্চতম দার্শনিক প্রজ্ঞায়।  যেই প্রজ্ঞায় সাধিত হবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কল্যাণ এবং আত্নত্যাগে মহিমান্বিত হবে শাসক এবং নাগরিক।

যেহেতু শিক্ষার মূল পাঠের চাবিকাঠি জ্ঞান সেহেতু এই জ্ঞান আসলে কি এই বিষয়ে প্লেটোর মতবাদ হলো জ্ঞান এমন বিষয়বস্তু যেটিবুদ্ধিবাপ্রজ্ঞারবিষয়বিশ্বাসেরনয় প্লেটোবলেছেন,

             “যথার্থজ্ঞান অকাট্যএবংতা সবসময়ই অস্তিত্বশীল বস্তুর নির্দেশক

প্লেটোর এই শিক্ষাদর্শনের পিছনে রয়েছে একটি রিয়ালিটির চিত্র যেটি পরীক্ষালব্ধ প্রমাণিত, যা আলোর মতো দেখা যায় এবং উপলব্ধির যোগ্য সেগুলোকে মূলত জ্ঞান বলে অভিহিত করা যায়। তাই প্লেটোর সর্বদা বিশ্বাস এবং প্রজ্ঞা কে আলাদা ভাবে সংজ্ঞায়িত করে বিশ্বাসকে অন্ধকার গুহার সাথে তুলনা করেছেন এবং প্রজ্ঞা কে দিয়েছেন চূড়ান্ত সীমার অধিকারী। 

প্লেটোর ঠিক এই দুই আলোচনার মাঝে একটি বিষয় গুরুতর ভাবে পরিলক্ষিত। “শিক্ষা” শব্দটির একটি অন্যতম নির্যাস “জ্ঞান” যেটি মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল রহস্য, লৌকিক-অলৌকিক সত্ত্বার ,জীবন ব্যবস্থাপনা এবং ন্যায়নীতির মূল অংশটুকু লুকিয়ে আছে। লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, জ্ঞান সেই ইতিহাস থেকে আজ অবধি এতোই মূল্যবনা একটি সম্পদ যার উপর কাঠামো হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্রনীতি-জৈবিক চাহিদা ইত্যাদি। প্লেটোর দর্শনের অভ্যন্তরীণ সেই মূল বিষয়টিই হলো শিক্ষাই একমাত্র একটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বলের জন্য দায়ী এবং এটি হতে হবে সকলের জন্য। কারণ একটি শিক্ষিত সমাজ একটি আদর্শ বাস্তব সম্মত রাষ্ট্রের সামিল যেখানে মানুষ ন্যায় অন্যায়ের পার্থক্য বুঝবে সঠিক পন্থা অবলম্বন করতে পারে যেই সিদ্ধান্ত সকলের জন্য বাস্তবসম্মত এবং উপকারী এবং সামাজিক অসমতা- বিশৃঙ্খলা নিরুপণের একটি অসাধারণ উপায়।

Comments

Popular posts from this blog

পোস্ট মর্ডানিজম :ভাবনাচিন্তা ও তত্ত্ব

মিশেল ফুকোঃ জ্ঞান,শৃঙ্খলা এবং ক্ষমতা

১৯ শতকে বাংলায় সমাজ সংস্করণ এবং ধর্ম সংস্কার