মিশেল ফুকোঃ জ্ঞান,শৃঙ্খলা এবং ক্ষমতা
বর্তমানে পাশ্চাত্য সমাজে সর্বাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে মিশেল ফুকো যেন এক শক্তিশালী ভাবাদর্শের নাম। মিশেল ফুকোকে পাঠ করা এবং সেই সাথে বিবেচনা করার অর্থ হলো নতুন করে সমাজ,ক্ষমতা,জ্ঞান ও ইতিহাসকে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে পাঠ করা। ফুকোর রচনা নির্ভরশীল হয়ে উঠে রাজনীতি-অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার নিরিখে। ফুকোর সময়কালে আরেক প্রভাবশালী ব্যক্তি জাঁক দেরিদা ছিলেন তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দী, ফুকো ষাটের দশকে স্ট্রাকচারালিস্ট আন্দোলনের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন,যদিও পরবর্তী সময়কালে তিনি সেই গোষ্ঠীর আর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। আমার বর্তমানের লেখাটি মূলত ফুকোর সামগ্রিক ভাবাদর্শগত জায়গাকে উন্মোচন করার প্রক্রিয়ায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে। সেই আলোচনা নিম্নে ব্যক্ত হলো
বিংশ শতাব্দীর ফরাসি দর্শনশাস্ত্রে মিশেল ফুকো সর্বাপেক্ষা আলোচিত,আলোড়ন জাগানো এক চিন্তাশীল ব্যক্তি।উত্তর আধুনিক চিন্তাধারা,সাহিত্যতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক প্রগতির ধারক বাহক হিসেবে ফুকো অধিক পরিচিত। জ্য পল সাত্রে,আলবেয়ার কামু,জাঁক দেরিদা ও জাঁক লাকা এর সাথে তার ভাবনাচিন্তা ও লেখাপত্র ফরাসি পন্ডিত মহলকে নাড়িয়ে দেয়। ফুকোর চিন্তাজগতে সমাজতত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্বের ক্ষেত্রে তার লেখালেখি ক্ষমতা ও জ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন ছিল সম্পূর্ণ নতুন তত্ত্ব এবং আদর্শিক স্থাপনা।
১৯২৬ সালের পশ্চিম ফ্রান্সের পোয়াতিয়ে শহরে জন্ম মিশেল ফুকোর। ১৯৪৫ এর দিকে যুদ্ধ থেমে যাওয়ার সাথে সাথে তিনি প্যারিসে ‘একল নর্মালে’ দর্শন ও মনস্তত্ত্ব বিষয়ের ছাত্র হিসেবে যোগদান করলেন। ১৯৬১ সালের দিকে প্রকাশিত হয় তার বিখ্যাত বিশাল ডক্টরাল থিসিস ‘ধ্রুপদী যুগের উন্মাদনার ইতিহাস’। এই বইটি হয়ে উঠে ইতিহাসের অভ্যন্তরীণ চিন্তার জগতকে পাঠ করবার নতুন আকার ও আঙ্গিক হিসেবে । ফলে তিনি হয়ে উঠেন ‘ চিন্তার জগতের ইতিহাস’ বিজ্ঞানী হিসেবে, দার্শনিক হিসেবে। উন্মাদনার ইতিহাসে দেখানো হয়েছে সপ্তদশ শতকে বা যুক্তির যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত পাশ্চাত্য সভ্যতা কিভাবে এই উন্মাদদের সঙ্গে ব্যবহার করেছে এবং কীভাবে এই ব্যবহার এবং প্রতিবিন্যাস এর আকৃতি ও কাঠামো বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও সামাজিক অবস্থার চাপে সময়ে সময়ে বদলেছে এবং এই রূপান্তরের অর্ন্তনিহিত অর্থই বা কী-এগুলোই ফুকোর মূল আলাপ আলোচনার বিষয় ছিল।
একটি বিষয়ে এবার গভীরে প্রবেশের জন্য উপযুক্ত হয়ে গিয়েছে তা হলো ‘মানবীয় বিজ্ঞানের একটি প্রত্নতত্ত্ব’ সহ শিরোনাম নামক বইতে (মূল গ্রন্থ- ‘শব্দরা আর বস্তুরা’) “Sciences” শব্দের অর্থ প্রচলিত অর্থে কোনো শুদ্ধ বিজ্ঞান নয়। এটা, আমর যাকে বলি আর্টস অর্থাৎ ইতিহাস ,দর্শন,সমাজতত্ত্ব,ভাষাতত্ত্ব ইত্যাদি। যে জ্ঞানচর্চা বিগত চার শতাব্দী ধরে পাশ্চাত্য মননকে ব্যস্ত করে রেখেছিল তা কিভাবে মূল প্রশ্নকে এড়িয়ে গিয়েছে সেটিই মিশেল ফুকোর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, সমস্যা এখানেই নিহিত। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে সমস্যাটি সরাসরিই জ্ঞানতাত্ত্বিক জায়গা থেকে। এখন প্রশ্ন আসতেই পারে ‘জ্ঞান’ শব্দটি তবে ফুকোর কাছে কি অর্থে দাঁড়ায়, প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো জ্ঞান হলো ফুকোর দর্শনে অন্যতম আলোচ্য বিষয়।
ফুকোর চিন্তায় জ্ঞানের অপর রূপ হলো ‘এপিস্টেম’ কিন্তু তা প্রচলিত অর্থে জ্ঞানকে নির্দেশ করে না। বরং তার মতে, জ্ঞান তখনই একটি সত্ত্বা যা বস্তু সম্পর্কে সর্বতোভাবে নিশ্চিত ও সত্য ধারণা দিতে পারবে। একটি বিশেষ যুগে বা কোনো নির্দিষ্ট সময়ে যে সামাজিক,অর্থনৈতিক বা অন্যান্য শক্তির সম্পর্কে আমাদের ভাষণ-লিখিত,কথ্যভাষা এর শৈলী বা তার গঠনের রীতিনীতিকে এক করে এবং যা ক্রমাগত আবির্ভূত হয় নানাবিধ শাস্ত্রের আলোচনা ও বিশ্লেষণকালে-তাকে ফুকো আখ্যা দিচ্ছেন জ্ঞান বা এপিস্টেম উল্লেখ্য যে, জ্ঞান হলো ফুকোর দার্শনিক শাস্ত্রে সৃষ্ট ক্ষমতাকে ব্যাখ্যা করবার অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। হেগেলের যুক্তি অনুসারে ইতিহাসের প্রতিটি বিষয়াদির মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলে যে ক্রমোন্নতি বিকাশ সাধিত হয় তা আসলে ঘটে তার অন্তঃশীলা অর্থ বা যুক্তির ফলে। কিন্তু মিশেল ফুকো দেখিয়েছেন ,এখানে কোনো ধাপে ধাপে,দ্বান্দিক ক্রমোন্নতির উপন্যাস বলতে কিছু নেই। ফুকোর মতে, “যা আছে তা সভ্যতা ও চিন্তাশৈলীর শেষে এক ধরনের বিচ্ছিন্ন ও খন্ড খন্ড চিন্তাশৈলী” এই অর্থে ফুকো যাকে বলছেন “জ্ঞান”। এখানে আরেকটি গুরুত্ব পূর্ণ আলোচনা সমগ্র মিশেল ফুকোর বই পড়লে বোঝা যাবে, তা হলো ‘শৃঙ্খলা’। রেনেসাঁ এর আমলে যে কোনো শাস্ত্রচর্চার মূল ছিল সাদৃশ্য নির্ণয় করবার পদ্ধতি। আর ধ্রুপদী যুগে জ্ঞান হয়ে গেল ‘প্রদর্শন’ দেখানোর রীতি। প্রদর্শন নীতিকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হলো চিন্তাকে এক কাঠামোবদ্ধ করে তোলার প্রয়াস ও প্রচেষ্টা। যাকে বলা হয় শৃঙ্খলা। ফুকোর এই শৃঙ্খলা নীতি এসেছে ট্যাক্সনমি শব্দ থেকে যার অর্থ শ্রেণীবদ্ধ করা। আবার ফুকো বলছেন এই শৃঙ্খলা ধীরে ধীরে গাণিতিক রূপ নিল তখনই একে সারীবদ্ধভাবে সাজানোর প্রয়োজনবোধ সৃষ্টি হলো,ক্ষমতার অস্তিত্বের চূড়ান্ত পর্যায় এখানে এসে দেখা যায়।
ইতিহাস ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক কাঠামো উদ্ভাবক হিসেবে ফুকোর চিন্তা ও বিশ্লেষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাকে পাঠ করবার পূর্বমুহূর্তেই তার দেওয়া ইতিহাসের বয়ান শোনা কিংবা বোঝাটা খুবই জরুরি। ফুকোর ইতিহাস ও ক্ষমতার পাঠের পিছনে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেছেন কার্ল মার্ক্স। কিন্তু বিরোধের জায়গাটি ছিল হেগেল এবং মার্ক্সীয় ঐতিহাসিক দ্বান্দিকতার সূত্রে, সেই সূত্র ধরে যখন জ্য পল সাত্রে বয়ান দিচ্ছিল যে শ্রেণী চৈতন্য এমন যে তার থেকে মুক্ত হওয়া বা নিজেকে শ্রেণী-চ্যুত করা কোনো ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয় সেখানে মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে চূড়ান্ত কর্মপ্রক্রিয়াই হলো বিপ্লবতত্ত্ব এবং তার ফলে কর্তৃত্বের শাসনের অবসান হবে। লক্ষণীয় জ্য পল সাত্রে এবং মার্ক্স দুজনেই ইতিহাসের বিন্দুগুলোকে নিয়ে তাদের চিন্তার জগতকে সম্পাদনা করেছেন, কিন্তু সাত্রের ইতিহাসনির্ভর তথ্য সম্পূর্ণ উনিশ শতককেই কেন্দ্র করেই গঠিত, যেখানে কিছু রূপকল্প ও ইউটোপিয়ান কন্সেপ্ট গঠিত হয়েছে। মার্ক্সের ক্ষেত্রে ইতিহাস দাড়িয়েছে বুর্জোয়া-প্রলেতারিয়াত, উৎপাদন প্রক্রিয়া ও সম্পর্ক নির্ভর। এখান থেকে মিশেল ফুকো কিছুটা আলাদা হয়ে সরে এসেছেন এবং তিনি বলছেন, ‘আমরা মানুষের সাম্প্রতিক প্রমাণে এমনই অন্ধ হয়ে গিয়েছি যে আমরা এটা মনে পর্যন্ত রাখি না যে সামান্য কিছুদিন আগে এমন একদিন ছিল যখন পৃথিবী ছিল,ছিল তার শৃঙ্খলা,ছিল মানুষেরা,কিন্তু ছিল না মানুষ’। এই বয়ানের সূত্র ধরে প্রমাণ করা যাবে ১৯৬৯ এর প্রকাশিত গ্রন্থ, যা পরবর্তীতে বিখ্যাত হয়ে উঠে, রচনাটি হলো “জ্ঞানের প্রত্নতত্ত্ব”। বইটি হলো একটি ম্যানিফেস্টো বা ইস্তেহার। এখানে দেখানো হয়েছে উত্তরাধুনিক চিন্তায় কিভাবে ইতিহাসকে বিচার ও বিশ্লেষণ করা উচিত তারই একটি খসড়া। ফুকো আলোচনা করেছেন সেই চিন্তার ইতিহাসকে নিয়ে যা ক্রমে ক্রমে অর্ন্তজাগতিক মূল্যকে গড়ে তুলেছে, সম্পর্ক স্থাপনে শৃঙ্খলা আনয়ন করেছে। এখানে মিশেল ফুকো তার বিখ্যাত ‘ইতিহাস’ শব্দটির একটি ব্যাখ্যা তুলে ধরলেন- ‘ইতিহাস শুধু ঘটনাস্রোতের বিবরণ নয়,তার ধারাবাহিকতা ও তার মধ্য থেকে একটা সুস্পষ্ট ক্রমোন্নতি,একাধিক মানুষের সংহত,সংঘবদ্ধ চিন্তার একত্ব,একটা সুস্পষ্ট বক্তব্য বা পরিণতিকে আবিষ্কার করার চেষ্টা।’ মূলত আলোচনার পরবর্তীতে বোঝানো হয় প্রাচীন পদ্ধতিতে আলোচনার মেথড যেমন ধারাবাহিকতা কে নিয়ে গঠিত,আধুনিকযুগে সেখানে ফুকো দেখছেন ছেদ। এরকম কয়েকটি ছেদ যার মধ্যে নেই কোনো গূঢ় তাৎপর্য, নেই কোনো প্রগতির ইঙ্গিত। একারণে তিনি ধারাবাহিকতার জায়গায় বর্তমান ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করেছেন ‘ধারাহীনতার’ ইতিহাসে। মানুষ নামক অতি পরিচিত প্রাণীটির জ্ঞান কিংবা চিন্তা কাঠামো ধারাবাহিকতা নিয়ে বর্তমানে পৌছায় নি। মানুষের চিন্তার ইতিহাসে প্রাধান্য পেয়েছে ধারাহীনতা সহ কালগত বিভিন্ন রকমের বিচ্যুতি। এই ধারাহীনতার জ্ঞানতত্ত্ব থেকে প্রকৃত চিন্তার ইতিহাস উপস্থাপন করতে গেলে আমাদের ভুলে যেতে হবে ইতিহাসগ্রস্ত নিয়তিকেন্দ্রিক চিন্তাপ্রক্রিয়াকে,যেখানে নৃতাত্ত্বিক চিন্তাধারার সাথে অবস্থান করে ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব। অর্থাৎ ফুকোর প্রত্নতাত্ত্বিক মডেলে জ্ঞানের মৌলিক উপাদান ভাষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ ফুকোর কাছে এপিস্টেমের বা জ্ঞানের ভাষণ-ক্রিয়া-পদ্ধতির বিশ্লেষণ ছাড়া চিন্তার ইতিহাস উপস্থাপনযোগ্য নয়। ফুকোর কাছে এই ধারাহীনতার ইতিহাস যা অদৃশ্যমান তাকে খুঁজে বের করাই এখন মূল কাজ। দীর্ঘসময়কাল ব্যাপী ইতিহাস চর্চার ধারা, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রতিটি সভ্যতার ইতিহাসকে পাঠ করবার যে প্রাগৌতিহাসিক নিয়ম প্রচলিত সেই ধাচের সম্পূর্ণ বাহিরে গিয়ে মানববিজ্ঞান শাখার নতুন ইতিহাস রচনাকারীদের মধ্যে তাই ফুকো সর্বদাই কার্ল মার্ক্স এবং ফ্রেডরিক নীৎশে কে সমর্থন করেন,তাদের প্রশংসাও করেন।
সমাজসত্তা, ক্ষমতা এবং যুদ্ধকে সাক্ষী রেখে ১৪ই জানুয়ারী,১৯৭৬ সালে তিনি বক্তব্য এবার পেশ করা শুরু করলেন। যেখানে অনুশাসন ও রাজকীয় ক্ষমতা -আইন, আধিপত্য ও দখল, নিয়মানুবর্তিতার ক্ষমতা,শাসন ও নিয়ম ইত্যাদি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ পর্যায়ে ১৯৭৬ সালের দিকে তুলে ধরলেন গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রশ্ন-
১) দর্শন যেখানে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে বা তুলে ধরে, সেখানে দর্শন কি ক্ষমতার প্রেক্ষাপটকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে?
২)ক্ষমতা কী ধরনের অনুশাসন প্রয়োগ করে সত্যকে সংজ্ঞায়ন করার জন্যে?
৩)কী ধরনের ক্ষমতা সত্যের আলোচনা উৎপাদন করতে সক্ষম?
ক্ষমতার বহুমুখী সম্পর্ক সমাজ তৈরি করে, চরিত্রায়িত করে,অতিক্রম করে অবিরত। সত্যের আলোচনার সাথে যেগুলোকে আলাদা করা যায় না, সেখানে সংগ্রহ,প্রচার ও প্রয়োগ ব্যতীত তাদের প্রতিষ্ঠিত বা কার্যকর করা সম্ভব নয়।সংগ্রহ,প্রচার ও প্রয়োগের ফলে একটি বিষয় সমগ্র ভাবে সত্য হয়ে উঠে, তাকে চেনা যায়। সত্যের আলোচনায় মিতব্যয়ীতা কাজে লাগাতে না পারলে ক্ষমতার সৌজন্যেই তাকে কাজে লাগানো যাবে না। সমাজে ক্ষমতা,অধিকার ও সত্যের ভেতরে এই সম্পর্ক বিদ্যমান এবং সুসংগঠিত। ক্ষমতাকে আরোহী পদ্ধতিতে বিবেচনা করা উচিত,অর্থাৎ শুরু করতে হবে ক্ষমতার অসীম কলকব্জা থেকে,যাদের নিজস্ব ইতিহাস,নিজস্ব গতিপথ,নিজস্ব কৌশল আছে৷নিজস্ব গুণে আচ্ছাদিত যে ক্ষমতার কলকব্জা রয়েছে, সেই কলকব্জা নিজস্ব প্রযুক্তি দ্বারা সমাজের প্রতিটি স্তরে তাকে কাজে লাগানো হচ্ছে, স্থানচ্যুত করা হচ্ছে অন্যান্য নিয়ম থেকে,রূপান্তর ঘটানো হচ্ছে প্রয়োজন মতো এবং ব্যবহার করা হচ্ছে প্রতিটি পদক্ষেপে। এক্ষেত্রে নিচুস্তরে প্রয়োগ করা ক্ষমতার ঘটনা,কৌশল ও কাজকর্মের ধরনকে বিশ্লেষণ করা দরকার,এই বিশ্লেষনের ফলে দেখা যাবে ক্ষমতার কর্মপদ্ধতি মূলত স্থানচ্যুত,প্রসারিত ও পরিবর্ধিত এবং ঘটনাপরম্পরা সৃষ্টি করে কাজে লাগানোর প্রক্রিয়ায় নিমজ্জিত। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতার প্রকার ও সীমারেখা নিয়ে ফুকোর আলোচনার প্রসঙ্গ ও ভাবনার জালের বিস্তার শুরু। অধিকারের নিয়ম প্রতিষ্ঠা করাই শ্রেফ ক্ষমতার লক্ষণ নাকি সে নতুন ভাবে পুর্নগঠিতও হতে পারে নব্য উপনিবেশবাদী চরিত্রের মতো যে চরিত্রের কাজই হলো নতুন উৎপাদিত তথ্য,পণ্য ও সামগ্রী দ্বারা গোটা গোষ্ঠীর একটি মনস্তাত্ত্বিক সম্মতি আদায় করার আপ্রাণ চেষ্টা। এই আদায়ে করার উপায়ে শারীরিক কসরতকে মাথায় না রেখে মানসিক দাসত্বে রূপান্তর করবার যে ক্ষমতা কিংবা নতুন ভাবে জ্ঞানের কাঠামো নির্মাণের যে শক্তিবলয় এবং স্বাভাবিক একটি জ্ঞান তা কিভাবে পরবর্তীতে হয়ে উঠে ‘শক্তি ও ক্ষমতার’ উৎস ইত্যাদি এসকল বিষয়াদি নিয়ে মিশেল ফুকো শুরু করেছেন তার যাত্রা অভিনব পদ্ধতিতে।
উদারনীতিবাদীরা হলের সাধারণ তত্ত্বে ব্যক্তির সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী, যেমনটি আমরা জন স্টুয়ার্ট মিলের বক্তব্য থেকে পাই , “গোটা মানবজাতির মধ্যে একটি বিশাল অংশ যদি এক পক্ষে থাকে এবং এর বিরুদ্ধে কেউ যদি ভিন্ন মতও পোষণ করে তবে তাকে অধিকার দেওয়াটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কেউ যদি সেখানে আক্রমণ করলো বা কন্ঠরোধ করলো তা যেন গোটা মানবজাতির কন্ঠরোধ করলে যে অন্যায় হবে সেই একই অন্যায় তার উপরও করা হবে বাধা দান করলে।” কিন্তু যদি এক বা একাধিক ব্যক্তিদের মধ্যে মতবিরোধ হয় তবে সেখানে করণীয় কি? এই প্রশ্ন এলেই উদারনীতিবাদীদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সামাজিক চুক্তির নীতিতে এসে সম্পর্ক স্থাপন করতে ব্যস্ত। এই চুক্তি অনুসারে সংখ্যা গরিষ্ঠ ব্যক্তিরা তাদের নিজেদের মতো আইন,আইন-প্রয়োগ সংস্থা এবং সরকারের সৃষ্টি করতে পারেন।সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ তাদের নিজস্ব অধিকার ও স্বেচ্ছার বলয়ে তারা সামাজিক ক্রিয়া কান্ডের শৃঙ্খলা বিধানের জন্য ক্ষমতার নতুন আধার তৈরি করে। ক্ষমতার কাজ তখন হয়ে দাঁড়ায় গণতান্ত্রিকভাবে প্রণীত আইন লঙ্ঘনকারীদের দমন করে সমাজের সমষ্টির গণতান্ত্রিক ইচ্ছাকে কার্যকরী করা। এই জন্য প্রয়োজন মতো
পার্লামেন্ট,মন্ত্রিসভা,পুলিশ,মিলিটারী,জেলখানা,আমলা ও প্রশাসক ইত্যাদি সব কিছুর তৈরি হতে পারে এবং এগুলির মাধ্যমেই গণ ইচ্ছার বাস্তবায়ন সম্ভব।কিন্তু একটি পর্যায়ে তা যতোটা না সকল বর্গের জন্য হয়ে উঠতে পারে তার চেয়ে বেশি তা বুর্জোয়া-পুজিপতি শ্রেণীর উদ্দেশ্যে হয়ে উঠে, ফলে সেখানে বুর্জোয়াদের ভ্রাতৃত্ব ও সাম্য প্রকাশ ঘটায়। গণতন্ত্র রূপ নেয় ‘বুর্জোয়ার ভোটের তন্ত্র’হিসেবে। মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ক্ষমতাকে দেখা হয় সর্বদা দমনের যন্ত্র হিসেবে,প্রকৃত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত থাকে অধিপতি শ্রেনীর হাতে। তারা সেটিকে ব্যবহার করে স্বীয় আধিপত্যকে রক্ষা করে। মাও-সে-তুং কখনও কখনও এই ধরনের শ্রেণীকে বলে গিয়েছেন উপরিকাঠামো শ্রেণী,যে একই কথা মার্ক্স ও গ্রামশির কাছ থেকেও এসেছিলো। এখান থেকে এবার বিস্তৃতির যাত্রা শুরু ফুকোর। বুর্জোয়া ভাবাদর্শ পরতে পরতে যেভাবে সিমেন্টেড তার আদর্শ বা ভাবাদর্শকে নিয়ে তা শ্রেফ একটি অবস্থানেই সীমাবদ্ধ নয়, তাকে প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে উৎযাপিতও করা হয়। যেখানে গ্রামসি বলছেন এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হেজিমনির প্রক্রিয়া যার দ্বারা সামগ্রিক রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক ক্ষমতাকে বৈধকরণ করা যায়।
উদারনীতিবাদী ও মার্ক্সবাদী উভয়চিন্তাধারা থেকে ফুকোর ক্ষমতা বিষয়ক চিন্তা পৃথক। ফুকো মনে করেন যেখানে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির কাছে ক্ষমতা হলো সার্বভৌমত্ব,সংবিধান,আইন-আদালত সেখানে মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে তা হলো নিছক রাষ্ট্রযন্ত্র। কিন্তু এর আগেও সৃষ্টি অন্যান্য অনেক তত্ত্ব ক্ষমতার পুরো মেকানিজমকে সঠিক ভাবে তৈরি করে পারেনি, একটি সামগ্রিক ডিসকোর্সের মধ্যে গঠিত হয়ে সার্বিক সত্য ইতিয়াহসের সংজ্ঞায় উপনীত হতে পারেনি বরং তা ছিল খন্ডে খন্ডে বিভক্ত। সেখানে মিশেল ফুকো ধার করলেন ‘শৃঙ্খলা ও শান্তি’ অধ্যায়ের তত্ত্ব ও ইতিহাস। মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্রের সময় শাস্তির মান এবং আধুনিক গণতান্ত্রিকযুগে শাস্তির মান এক নয়। এক সময় প্রভু বা রাজার নির্দেশ মোতাবেক সমগ্র শহরজুড়ে অনুষ্ঠান আয়োজন হতো, সরাসরি দেখানো হতো শাস্তিকে। কাউকে গিলোটিনের নিচে রেখে মাথা কেটে ফেলা হতো কিংবা পুড়িয়ে হত্যা করা হতো। রাজার নির্দেশের বর্হিঃভূত কোনো কাজই শাসনের বিরুদ্ধে বা বিপরীতে কাজ। ফলে তাকে হত্যা করা হতো। কিন্তু পরবর্তীতে ফরাসী বিপ্লব সংগঠিত হয় মানুষকে স্বাধীনতা দেবার উদ্দেশ্যে, মানবতাকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে। গণতন্ত্রকে মানুষ মানসম্মত ও আদর্শ হিসেবে ধরে নিলে গণতন্ত্রের যুগ প্রতিষ্ঠিত হওয়া শুরু করে। ফুকো দেখাচ্ছেন, এই আধুনিক গণতন্ত্রের যুগে দাঁড়িয়ে শাস্তি এখনও আছে কিন্তু রাজার ন্যায় নয়। রাজার ক্ষমতা ছিল সৈন্যসামন্ত ও অস্ত্রের বলে, আর এখন ক্ষমতার উৎস হচ্ছে রাষ্ট্র,আইন-আদালত ইত্যাদি। আর এখানে আনুষ্ঠানিক ভিত্তি হচ্ছে নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অভিমত ও ভোট। আধুনিক যুগের মূল্যবোধ হচ্ছে ‘ব্যক্তির সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী’। এই যুগে শাস্তির উদ্দেশ্য ও মানও ভিন্নতর। ফুকো একটি চমৎকার বাক্য এখানে উচ্চারণ করেছেন, এই শাস্তির লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে অপরাধীর ‘আত্না’ এবং উদ্দেশ্য হচ্ছে “অপরাধীর চরিত্র সংশোধন”। প্রশ্ন হলো আধুনিক গণতন্ত্রের যুগে শাস্তি তবে কি এবং কেমন? ফুকো এখানে ইতিহাসের জবানে বলছেন যে, রাজতন্ত্রের আমলে শাস্তির এই ভয়াবহতার ফলে প্রজাদের মধ্যে অসম্ভব রকমের ক্ষোভ ও বিদ্বেষ দেখা যেত ,ফলে প্রজা বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। মধ্যযুগীয় শাস্তিকে রোধ করার জন্যই মানুষ বিদ্রোহে অংশ নিয়েছে এবং দাবী ছিল শাস্তির উপায় যথেষ্ঠ অন্যায়মূলক এবং বিতর্কিত।এখানেই বিদ্রোহ সংগঠিত হলে সিস্টেমের মধ্যে একটি পরিবর্তন সাধিত হয় এবং সাম্রাজ্যের পতন ঘটা শুরু হয়। মানুষের দাবী ছিল মানুষের শাস্তির এই উপায় বিলীন করে দেওয়া হোক এবং প্রতিষ্ঠিত হোক একটি আইনের আদলে গঠিত মানুষের জন্য সংবিধান। ফুকোর ভাষা এই উপায়টি হলো “শাস্তির নম্র উপায়”। এভাবে সৃষ্টি হয় গণতান্ত্রিকযুগের ‘কারাগার’। ফুকোর ডিসিপ্লিন ও পানিশমেন্টে পরে বলা হয়েছে আধুনিক সমাজে হচ্ছে “শৃঙ্খলা বিধানকারী সমাজ”। কিন্তু শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে শ্রম বিভাজনের সৃষ্টি করতে হবে নয়তো ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটাতে পারবে না। এমনকি ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতারও সৃষ্টি করতে হবে। এভাবে শ্রমবিভাজন ও বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি করে আধুনিক সমাজ কাজের ফল অনুযায়ী তাকে তিরস্কার ও পুরস্কার প্রদান করবে, শ্রমের বিভাজনে নেতা বা কোনো সামঞ্জস্য না থাকলে কিংবা ঘাটতি থাকলে সেখানে উপরিকাঠামোর ব্যক্তিবর্গ সমন্বয় সাধন ও নিয়ন্ত্রণ করবে এবং তাদের নিয়ত তদারকি করবে। হাসপাতাল,কারাগার,বিদ্যালয়,ফ্যাক্টরী,সেনা ব্যারাক ইত্যাদির মধ্যে যে চরম ক্ষমতা নিহিত আছে তাই ব্যাখ্যা করতে চাচ্ছেন ফুকো। যেমনঃ কারাগারের সকল ইচ্ছা নিয়ন্ত্রিত হয় একজন প্রধান কর্মকর্তার দ্বারা। সেই সবসময় চব্বিশ ঘন্টা যে কারো উপর তদারকি করছেন এবং সেই নির্ধারণ করছেন কার শাস্তির মাত্রা কতোটুকু হওয়া উচিত। মানসিক রোগীর কারাগারে যখন ডাক্তার তার মনমতো পদক্ষেপ নিয়ে তিনি সমস্ত রোগীদের চিকিৎসা করছেন এবং এই কারাগারের ভেতরে ডাক্তার হয়ে উঠেন একজন কর্তৃত্ববাদী শাসক হিসেবে, কারণ তার কথার উর্ধ্বে আর কেউ অবস্থান করেন না। কিন্তু শাস্তির মাত্রা শারীরিক নয়, আত্নাকে শাসন করাই হচ্ছে কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রধান লক্ষণ। কারণ সেই শাসককে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে হলে গণতন্ত্রের নির্দিষ্ট ম্যানডেটকে অন্তত টিকিয়ে রাখতে হবে। এ কারণে মিশেল ফুকো উক্ত প্রতিষ্ঠান সমূহকে বলছে সেগুলো পৃথক পৃথক ‘সমগ্র’ মাত্র, এর দ্বারা সে মানসিকভাবে শৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়। ফুকোর বিশ্লেষণ অনুসারে, প্রত্যেকে প্রত্যেককে পাহারা দিয়ে রাখছে। আমার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমাকে পাহারা দিচ্ছেন,আমি পাহারা দিচ্ছি আমার কর্মচারীকে।যদিও এই নতুন যুগের পাহারাদারেরা আগের মতো বেত মেরে,কারাগারে বন্দী করে বা অর্থদন্ড দিয়ে শাস্তি দিচ্ছেন না। বরং তাদের মর্জির উপর নির্ভর করছে একজন ব্যক্তি হিসেবে আমার কি পদোন্নতি পাওয়া উচিত নাকি পাওয়া উচিত না। ‘উচিত কি উচিত না’ এই ডিসকোর্স আমাদের সাধারণের হাতে নেই, এর মালিক হলো উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এর মালিক হলো উপরের কাঠামোর নিয়ন্ত্রণকারীরা। ফলে আমরা নিজেদের যতোই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বাধীন নাগরিক বলে চিৎকার দিয়ে উঠি না কেন আমাদের মাথার উপরে সেই অদৃশ্য ওয়াচ টাওয়ার বিদ্যমান যেখান থেকে আমাদের পুরোটা সময় নজরদারী করে যাচ্ছে। এখানে এসে আমরা ফুকোর বিখ্যাত ক্ষমতার তত্ত্বটি লাভ করতে পারি। ফুকো বলছেন , “ক্ষমতা শুধু বিচ্ছিন্ন করে, দমন করে,বিমূর্ত করে,ঢেকে রাখে, লুকিয়ে রাখে-এসব নয় বরং ক্ষমতা হলো তাই যা ‘উৎপাদন করে’।এটি উৎপাদন করে বাস্তবতা,এটি নির্ধারণ করে বস্তুর বিচরণসীমা এবং নির্মাণ করে সত্যের তন্ত্রসমূহ”। অর্থাৎ ফুকোর ক্ষমতার মেকানিক্স হলো তিনটি- শৃঙ্খলা,কর্মবিধি, নির্দিষ্ট মান স্থাপন। এভাবেই গঠিত হয়ে যাচ্ছে গঠনতন্ত্র,প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ক্ষমতার বেড়াজাল সমগ্র বিশ্বজুড়ে।
Comments
Post a Comment