১৯ শতকে বাংলায় সমাজ সংস্করণ এবং ধর্ম সংস্কার


১৯ শতকে বাংলার সমাজ এবং ধর্ম সংস্করণের জন্য অনেক পদক্ষেপ নেয়া হয় যেমন রাজা রামমোহনের ব্রাক্ষ্ম সমাজ, ইয়াং বেঙ্গল দল, হিন্দু মুসলিম কলেজ প্রতিষ্ঠা, ঈশ্বরচন্দ্রের এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সমাজ সংস্কার আন্দলন ইত্যাদি কিন্তু এই আন্দোলন গুলো কি সেই সম্পর্কে আলোচনা করার আগে হুট করেই কেন ১৯শতকে এই আন্দোলনগুলো সব একসাথে শুরু হয় সেটা নিয়ে আলোচনা করাটা জরুরী এজন্য আমাদের একেবারে প্রাচীন আমল থেকে শুরু করতে হবে আলোচনাটি

বাংলার ইতিহাস দেখলেই বোঝা যায় প্রাচীন আমলে যেই রাজারা ছিলেন সবাই মোটামুটি হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ ছিলেন যদি আমরা চন্দ্রগুপ্ত মোর্যের মোর্য বংশের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো যে এই বংশের রাজারা প্রথমে হিন্দু থাকলেও পরে সম্রাট অশোকের সময় বোদ্ধ হয় এরপরই আসলে হিন্দু এবং বোদ্ধ রাজারা বাংলায় শাসন করলেও মুসলিম বা খ্রিষ্টান কোনো রাজা ছিলো না শুধু এই চারটি ধর্মের কথা বলছি কারণ জৈন ধর্মের তেমন কোনো ভুমিকা আসলে আমরা দেখতে পারি না যেকথায় ছিলাম এরপরবর্তিতে যখন মধ্যপ্রাচ্য সহ ইউরোপ আফ্রিকাতে ইসলাম ধর্ম জনপ্রিয়তা লাভ করে তখন এই ভারতবর্ষেরও এর হাওয়া লাগতে থাকে সুফি সাধকরা আসা শুরু করে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এরপর আসে মুসলিম শাসকেরা যেমন উমাইয়া খলিফা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের জামাতা মুহাম্মাদ বিন কাশিম সিন্ধু জয় করেন কিন্তু মুসলিম শাসন তখনো এখানে শুরু হয় না হলেও আফগান, তুর্কি কিংবা পারস্যের সম্রাটরা দেশজয়ের উদ্দেশ্যে আসতে শুরু করেন এই ভারতবর্ষে যেমন গজনির সুলতান মাহমুদ তাদের একজন এরপর আসেন মুহাম্মাদ ঘুরি যিনি কিনা ভারতবর্ষ জয় করেন এবং শুরু হয় দিল্লির সালতানাত এরপর ইখতিয়ার উদ্দিন বিন মুহাম্মাদ বিন বখতিয়ার খলজির বাংলা জয়ের মাধ্যমে এবং তখন থেকেই আসল ঝামেলা শুরু হয় এতো এতো বিদেশি ভারতবর্ষে এসে এখানে ধর্ম প্রচার করছে এটা হিন্দুরা মেনে নিতে পারেনি কারণ এতদিন পুরো ভারত তাদের হাতেই ছিলো এবং মুসলিমদের মেনে না নেয়াটাই স্বাভাবিক তারউপর হিন্দু রাজারাও মুসলমানদের সাথে পেরে উঠছিলো না মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের বিদ্বেষের প্রমাণ হিন্দুদের মুসলমানদেরজব্বনউপাধি দিয়ে আলাদা করে দেয়া কিংবা সিলেটে রাজা গৌড়গোবিন্দের সুফি আউলিয়াদের হত্যা এবং নির্যাতনের কাহিনী থেকেই পাওয়া যায় কিন্তু দিল্লির নিজামউদ্দিন আউলিয়া বা হযরত শাহজালালের বাংলায় আগমন ভারতের মানুষের কাছে ইসলাম ধর্মকে জনপ্রিয় করে তোলে ফলে হিন্দুরা অনেকটা ছন্নছাড়া হয়ে যায় রাজপুত রাজ্য (বর্তমানের সিন্ধু, রাজস্থান, কাশ্মির, পাঞ্জাব, বিহার, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, হিমাচল) হয়ে ওঠে হিন্দুদের একমাত্র শক্তিশালি অংশ এরপরবর্তিতে যখন সম্রাট বাবর ১৫২৬ সালে এখানে আসেন তারপরে ১৫২৭ আমরা বাবরের বিরুদ্ধে রাজপুতদের অভিযান এবং পরাজয় দেখতে পাই এর ফলে হিন্দুরা আরো বেশি শক্তিহীনতায় ভুগতে থাকে এরপর হিন্দুদের ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ছোটখাটো বিদ্রোহ করতে দেখা গেলেও কোনোটাই সফল হয়নি এসব দেখে সম্রাট ববর তার বাবরনামা বইতে এদেশের মানুষকে অলস, চিন্তাশীল নয়, উদ্ভাবনীশক্তি এবং ইচ্ছাহীন এসব বলে আখ্যায়িত করেছেন এরপর থেকে হিন্দুরা আর বড় কিছু করতে না পারলেও সম্রাট আকবরের সময় আমরা রাজপুত শাসকদের উত্থান কিছুটা দেখতে পারি সম্রাজ্য বাড়ানোর লক্ষে সম্রাট আকবর রাজপুত শাসকদের বিভিন্ন উচ্চপদে বসান এবং শুধু তাই নয়, এক রাজপুত রাজকন্যাকে তিনি বিবাহও করেন সেই সাথে এই ধর্মীয় ভেদাভেদ দূর করার জন্য তিনি দীন--ইলাহিনামক একটি ধর্মেরও প্রবর্তন করেন কিন্তু এই ধর্মটি তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি পরে জ্ঞান চর্চার প্রাণকেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় সম্রাট আকবরের দরবার কিন্তু পরবর্তিতে আবারও সম্রাট আরঙ্গজেবের সময় হিন্দুদের অবদমিত করা হয় এবং সুন্নী কট্টরবাদী সম্রাজ্য বানানো হয় ভারতকে হিন্দুরা আবার পিছিয়ে পরা শুরু করে এই রকমভাবে চলে ইংরেজ শাসন শুরুর আগ পর্যন্ত এই সময়টুকু মুসলমান শাসকেরা হিন্দুদের তেমন কোনো সুযোগই দেয়নি এবং এই সময় হিন্দুদের ধর্মের এবং সমাজেরও উন্নয়ন হয়নি এর মূল কারণ ছিলো হিন্দুধর্ম অনেক প্রাচীন এবং কুসংস্কারপূর্ন হওয়ায় সেই সাথে ছিলো ভারত শাসনের গৌরবময় ইতিহাস হুট করেই তাদের থেকে উন্নত, উন্মুক্ত, একঈশ্বরবাদী, আধুনিক ধর্ম ইসলামের অনুসারী মুসলমানদের ভারত দখল এবং শাসন তারা মেনে নিতে পারেনি সেই সাথে দেখা যায় ব্রাক্ষ্মণ বা ক্ষত্রিয়রা তেমন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি করেছে নিচু জাতের হিন্দুরা বা বৈশ্য শুদ্ররা তাই মুসলমানরা সারাজীবনই হিন্দুদের কাছে জব্বন থেকে গেছে এরপর আসে মুসলমানদের জন্য খারাপ সময় হুট করেই তাদের গৌরবজ্জ্বল শাসনের পতন ঘটে শিল্পবিপ্লবের সময় ইংরেজদের হাতে চলে যায় ভারত সেই সাথে হিন্দুরা মুসলিম ব্যতিত আরেকটি ধর্মের মানুষ পায় এবং তাদের আকড়ে ধরে


যদিও প্রথমদিকে ফকির সন্ন্যাসি আন্দোলন দেখা যায় কিংবা সিপাহি বিপ্লব দেখা যায় যেখানে মুসলমান এবং হিন্দুরা একসাথে হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে কিন্তু হিন্দুরা এই পতনের আফসোস থেকে মুক্তি লাভ করে খুব তাড়াতাড়ি এবং ইংরেজদের শাসনের সাথে নিজেদের মানিয়ে নেয় তারা এটি বুঝতে পারে যে তাদের উন্নতির জন্য ইংরেজি শিক্ষা, নিজেদের ধর্ম সংস্কার এগুলো দরকার দরকার  উন্নতি জাতি ইউরোপিয়দের অনুকরণ করা তাদের ধরে নিজেদের উন্নয়ন করা এরপরই আমরা রাজারামমোহনের ব্রাক্ষ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা দেখি এই ব্রাক্ষ্মসমাজ মূলত হিন্দুদের সামাজিক সমস্যা গুলোকে সমাধান করার চেষ্টা করতো  ইংরেজ শাসকের সাহাজ্যে করেন তৎকালীন সময়কার সবচেয়ে বর্বর বাজে প্রথা সতিদাহ প্রথার বিলোপ এরপর ইশ্বরচন্দ্রের বিধবা বিবাহ প্রথা চালু দেখি দেখি বঙ্কিমচন্দ্র বা রবিন্দ্রনাথকে হিন্দু সমাজের সমস্যা নিয়ে লেখনির মাধ্যমে আন্দোলন করতে সমাজের মানুষকে আলোকিত করতে যে আমাদের সমাজ করো পিছিয়ে আছে, কতোটা অগোছালো, কতো স্বার্থপর তারা লেখেন যৌতুকের বিরুদ্ধে, তারা লিখেন সামাজিক কুসংসাকের বিরুদ্ধে অন্যদিকে হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষায়ও অনেক উন্নতি করে এবং এই উপমহাদেশে হিন্দুদের কলেজও দেখা যায় প্রথম সাথে দেখা যায় ইয়াং বেঙ্গল দল যারা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করতো এবং সমাজে মুক্তবুদ্ধি ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করতো তারা মূলত ডিরোজিওর অনুসারি ছিলেন এটিও শুরু হয় হিন্দু কলেজেই এইসব যুগান্তকারি পরিবর্তনের জন্য হিন্দুরা মূলধারাইয় খুব কম দিনেই চলে আসে এবং সরকারি উচু উচু পদে যাওয়া শুরু করে অন্যদিকে মুসলিম খিলাফতেরর সময় থেকেই মুসলমানদের উদ্দেশ্য ছিলো ইসলামকে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া কিন্তু ইউরোপে তাদের ৪০০ বছরের সম্রাজ্য পতন এবং আফ্রিকাতেও তাদের ক্ষমতা হারানোর পর তারা মূল ক্ষমতার বাহিরে চলে যায় সেই সাথে ভারতেও ক্ষমতা হারায় ফলে তারা এই ধাক্কা সহজে সামলে উঠতে পারেনি যেই সমস্যায় হিন্দুরা পড়েছিলো মুসলমানদের আগমনের সময় সেই সমস্যায় এখন পড়লো মুসলমানরা ফলে যেই মুসলমানরা হিন্দুদের থেকে এগিয়ে ছিলো সেই মুসলমানরাই এখন হিন্দুদের থেকে পিছিয়ে পড়লো এদিকে ইংরেজরা এদেশে কখনোই ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য পোষণ করেনি তাদের উদ্দেশ্য ছিলো ব্যবসা বাণিজ্য সেটিকে পুজি করে হিন্দুরা একদিকে এগিয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে মুসলমানরা পিছিয়ে পরছে এই ব্যপারটি হাজী মোহাম্মদ মহসীন এবং আমির আলীর মতো মানুষেরা লক্ষ করেন তারা মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য চেষ্টা শুরু করেন হয় আলীগড়ের আন্দোলন সেই সাথে নওয়াব আব্দুল লতীফ প্রতিষ্ঠা করেন মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি যেখানে মুসলমানদের শিক্ষা সহ নানারকম সমস্যার সমাধান শিক্ষার প্রসার বৃদ্ধির জন্য কাজ করা হয় এদিকে বেগম রোকেয়া নারীদের এগিয়ে নিতে মাঠে নামেন কাজ করেন শক্ত হাতে নারীদের সমাজে এগিয়ে নিয়ে আসেন লেখনির মাধ্যমে সামাজিক সমস্যাগুলো তুলে ধরেন অন্যদিকে হাজী শরিয়তুল্লাহ এবং দুদু মিয়ার মাধ্যমে ধর্ম সংস্কারের কাজ শুরু হয় ফরায়েজি আন্দোলনের মাধ্যমে এই আন্দোলনগুলোর দ্বারা এবার মুসলমানরা হিন্দুদের সাথে উন্নয়নে পাল্লা দেয়া শুরু করে বেড়ে ওঠে হিন্দু মুসলমান দন্দ্ব


এই সমাজ ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ফলাফল মূলত দেখা যায় ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান বিভক্তের সময় অনেক আগে থেকে হিন্দু মুসলমান ব্যবধান থাকলেও আমরা বিভিন্ন সময় তাদের এক হতে দেখি যেমন আকবরের সময়, ফকির সন্যাসি আন্দোলনের সময়, কিংবা সিপাহি বিপ্লবের সময় কিন্তু এই সমাজ ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের সময় তাদের মধ্যে একটা রেসের শুরু হয় কারণ এই দুটি ধর্মের মানুষ দুটো আলাদা সময় ইংরেজদের শাসনকে পুজি করে নিজেদের উন্নতি করা শুরু করে ফলে তাদের মধ্যে একটা বড় ব্যবধান তৈরি হয় এরপর আমরা দেখি বঙ্গভঙ্গের সময় হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদটা আসলে কতো বড় এরপর ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনগুলোও হিন্দু মুসলমান আলাদা হয়ে যায় বিশেষত ১৯০৬ সালে মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠার পরে এরপর ১৯৪১ লাহোর প্রস্তাবে আমরা সবাই দেখেছি হিন্দু মুসলমান আলাদা দেশের দাবী এবং অবঃশেষে ১৯৪৭ এর দেশভাগ

এদেশের সমাজ ধর্মীয় সংস্কার মূলত হিন্দু মুসলমান একসাথে হওয়া দরকার ছিলো কারণ বর্তমান সময় আমরা ধর্মীয় যেই ঝামেলা কিংবা এতো বিশাল গ্যাপ দেখতে পাই এটার মূল ছিলোই এই সমাজ ধর্মীয় সংস্কার আলাভাবে হওয়া একই সমাজে বসবাস করে যখন ধর্মভিত্তিক আলাদা আলদা সমাজ সংস্কার হয় তখন আপনাআপনিই একটি বড় ব্যবধান তৈরি হয় এবং এটির ফলাফলও ভালো হয় না তারউপর ১৯শতকের এই সমাজ ধর্মীয় সংস্কার হিন্দু ধর্মকে অনেকদূর এগুয়ে নিয়ে যায় কিন্তু অন্যদিকে মুসলমানদের ভেতর এই আন্দোলনগুলো হলেও সেটি মুসলমানদের বেশিদিন এগিয়ে নিতে পারেনি কারণ হুট করে পুরোবিশ্বের ক্ষমতা মুসলমানরা ইউরোপিয়দের কাছ থেকেই হারায় যার ফলে তারা হিন্দুদের মতো ইউরোপিয়দের মেনে নিতে কখনোই পারেনি যার প্রমাণ আমরা খিলাফত আন্দোলনের সময় দেখি ফলে উন্নয়নের দিক দিয়ে মুসলমানরা হিন্দুদের থেকে অনেক পিছিয়ে পরে  

Maruf Hassan
Debater,DUDS(Dhaka University Debating Society)
Department of Communication Disorder
University of Dhaka


Comments

  1. সুন্দর লেখা, বানানের দিকে মনোযোগী হলে পড়তে আরেকটু আরাম পেতাম।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

পোস্ট মর্ডানিজম :ভাবনাচিন্তা ও তত্ত্ব

মিশেল ফুকোঃ জ্ঞান,শৃঙ্খলা এবং ক্ষমতা