সামির আমিনের সাথে উপনিবেশিক রাজনীতির পাঠঃ- আন্তর্জাতিকতাবাদ।




বিশ্বায়ন কোনো নতুন বিষয় নয়। বরং এটি হচ্ছে পুঁজিবাদী ধারণার পুরোনো একটি মতবাদ।ভারতবাসীরা এর আচরণ ভালোকরেই জানবেন । ১৮ থেকে ২০ শতাব্দী পর্যন্ত ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে এবং যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সেটাই ছিল তাদের বিশ্বায়ন। শোষিত গোষ্ঠী শুধুমাত্র বৈশ্বিক পুঁজিবাদী সিস্টেমের মধ্যে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেছে। উপনিবেশবাদ হলো তাই বিশ্বায়নে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করার একটি প্রধান হাতিয়ার। ভারতবাসীদের মধ্যে যারা ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্যে আন্দোলন করেছিল সেগুলো সমাজতান্ত্রিক বৈপ্লবিক লিডারশিপের উপর ভিত্তি করে নয়, বরং মহাত্না গান্ধী কিংবা নেহেরুর পদক্ষেপগুলো ছিল জাতীয়ভাবে জনপ্রিয়তম আন্দোলন।

১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা এসে দুইটি মূলধারার উপর ভিত্তি করে। এর মধ্যে প্রথমটি হলো ,উপনিবেশবাদের ক্রিমিনাল এক্টের ফলাফল। যার কারণে সমগ্র ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নামক দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। এবং দ্বিতীয়ত, ভারতের স্বাধীনতার পেছনে একদল ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর হাত রয়েছে যার মধ্যে অন্যতম কংগ্রেস দল ,তাদের ছায়াতলে ছিল একদল শ্রমশ্রেণীর দল। কংগ্রেস দলের নেতৃত্বে এই জনপ্রিয়তা ছিল সর্বোচ্চ শিখরে। 


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্বায়নের চিত্র হয়ে যায় ‘দ্বিমুখী’- আমেরিকা ও সোভিয়েত স্নায়ুযুদ্ধে নিজেদের অবস্থান করিয়ে নেয়। এটি আসলে একটু ভুল চিত্রায়ন। বরং আমি বলতে চাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এই সময়কালটি ছিল “বিশ্বায়নের সাথে সমঝোতা”। আমি বোঝাতে চাচ্ছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া,আফ্রিকা এর সরকার আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের (যারা বৈশ্বিক ক্রমকে নিয়ন্ত্রণ করে )সৃষ্টি করা বহুমেরুকরণের স্ট্রাকচারের মধ্যে সমঝোতার কাঠামো সৃষ্টি করে। এই ধরনের কাঠামোগুলো ছিল সাম্রাজ্যবাদের উপর ভিত্তি করে গড়া এবং বাধ্য করা হয়েছিলো কিছু পাওয়ার ব্লকে যেমনঃ রাশিয়ার বিপ্লব ১৯১৭ সাল, চীনে বিপ্লব ১৯৫০ ও বান্দুং সম্মেলন ১৯৫৫ সাল যখন সংঘটিত হয়েছিল তাদের মধ্যে। এগুলো প্রয়োগ করা হয় দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলোর উপর যেমন ভারত ইন্দোনেশিয়া, তানজানিয়া ও ঘানা যারা স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়েছিল। চারটি ঐতিহাসিক ব্লককে কেন্দ্র করে বিশ্বায়নের সমঝোতা নীতি সৃষ্টি করা হয়েছিলঃ- 


১। সাম্রাজ্য বাদী আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের হাত ধরে মিত্রপক্ষের জোট গঠন করা হয় জাপান,অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার সমন্বয়ে।

২। সোভিয়েত পূর্ব ইউরোপে নিজের পক্ষবাদী দল গড়ে তোলে।

৩। পিপল রিপাবলিক অফ চায়না ১৯৫০ সাল পর্যন্ত নিজেদের সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে স্বাধীনতার রোডম্যাপ স্থাপন করে ফেলে। 


৪। বান্দুং সম্মেলনের মাধ্যমে গঠিত হয় “ন্যাম” সংগঠন যেখানে এশিয়া,আফ্রিকা ,চীন সকলেই একত্রিত হয় ইন্দোনেশিয়ায়। এই সংগঠন গঠিত হবার কয়েকবছর আগেই ভারত স্বাধীন হয়, ইন্দোনেশিয়া ডাচদের থেকে মুক্ত হয়, চায়নায় কমিউনিস্ট পার্টি বেইজিং দখল করে নেয় । মূলত এই সংগঠন নব্য স্বাধীন দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত হয়। কিছু বছর পরে পর্তুগিজদের উপনিবেশিক দেশগুলোও অংশ নেয় সর্বশেষ আফ্রিকা নেয়। এই দলে যোগ দেওয়া লাতিন আমেরিকার একমাত্র দেশ ছিল কিউবা । জাতিসংঘের অভ্যন্তরে থাকা ১৩৫ টি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র গ্রুপ-৭৭ এ থেকে দক্ষিণকে লিড করে। 


বিশ্বায়নের প্যাটার্ন স্পষ্ট করে দেয় পৃথিবীতে আসলে বহুমেরুকরণের বিশ্বায়ন ছাড়া সম্ভব নয়। এর প্রধান চিন্তা ছিল চারটি পার্টের সাথে সমঝোতা সৃষ্টি করবে।   কিভাবে সফল হলো তারা?


পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের চোখে সদ্য স্বাধীনপ্রাপ্ত দেশগুলোতে নিজেদের হস্তান্তর শুরু হয়ে গিয়েছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকাল থেকেই। সেটি হলো জাতীয় যে সকল জনপ্রিয় মুভমেন্ট বা আন্দোলনের ফলে তারা স্বাধীন হয়েছে তাদের সাথে বসে লিয়াজু সৃষ্টি করেছে। একই ঘটনা আফ্রিকাতেও। পশ্চিমারা তাদের ডিমান্ডের সাথে দক্ষিণের ডিমান্ডকে একত্র করে পরবর্তীতে দেখালো কেন বিশ্বায়নের একটি ‘কমন ফ্যাক্টরের’ দিকে একত্রে সকলকে ধাবিত হতে হবে। সেই সময়কালে ,অর্থাৎ দক্ষিণের স্বাধীনতা পর্বরতী সময়কাল থেকে প্রধান চিন্তাই ছিল অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বাজার সম্প্রসারণ (যদিও বাজার সম্প্রসারণের রীতিনীতি আফিমের প্রথম ও দ্বিতীয় যুদ্ধের সময়কাল থেকেই ব্রিটিশদের হাত ধরেই এসেছে, সেটি ছিল কলোনিয়াল পুজিসাম্রাজ্য)। একে পুঁজি করে পশ্চিমা তখন তাদের ছাঁচের মধ্যে ফেলে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নকে ঠিক করে দেয়, ফলাফল নিম্নরূপ-


পশ্চিমাদের চিন্তাই ছিল “পশ্চিমা সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার” নীতিকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান করবে যেন শ্রমজীবী শ্রেণিদের সম্মতি লাভ করতে পারে। এতে সফলও হলো।উন্নয়নও হলো। অন্যদিকে সোভিয়েত ব্লক, কিউবা,চীনে দেখা গেল সমাজতান্ত্রিক ঘরানার রাজনীতিতে ভিন্ন ধরনের ডেভেলপমেন্ট এবং সর্বশেষ পপুলিস্ট ধরানার রাজনীতিতে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যভাবে উন্নয়নের চিত্র দেখতে পায়। (কিছু জায়গায় মধ্য বাম ঘরানার তো কিছু জায়গায় সমাজতন্ত্রের কিছু কিছু ধারণাকে নিয়ে)

এবার আসুন বৈশ্বিক পুঞ্জিভবনের নীতিতে, রাষ্ট্রসমূহের ব্যবস্থা হলো পুঁজির বৈশ্বিক সম্প্রসারণের ফলাফল। ধনী ও গরীব রাষ্ট্রগুলোর অবিচ্ছেদ্য। বিশ্বায়নকে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের একট সম্প্রসারণ তত্ত্ব বলা হয়। প্রান্তস্থ দেশগুলোতে উন্নয়নগুলো খুবই অসম। তাদের অনুন্নয়ন আসলে উন্নয়নের কোনো ঘাটতি নয় বরং ধনী দেশের উন্নয়নের উলটো পিঠ। ধনী দেশগুলোর বিকাশ আসলে অন্য দেশের শোষণের উপর নির্ভরশীল এবং সেটাই অনুন্নয়ন ঘটায়। এই সমঝোতা নীতি মূলত বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই গরিব দেশের স্বার্থের বিনিময়ে ধনী দেশগুলোর সমৃদ্ধিকে পৃষ্ঠপোষকতা করে। দক্ষিণের সাথে যখন পশ্চিমা ওয়েল ফেয়ার সিস্টেমের সাথে হাত মিলিয়ে নেয় যখন ,তখন থেকে পুঁজির সম্প্রসারণ সেই নির্দিষ্ট স্থান ও সময় থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণের বাজারে অবাধ চাহিদার সৃষ্টি করতে থাকে। উপনিবেশবাদের একটা আচরণ দেখানো যাক-


ইয়রো কেন্দ্রিক ইতিহাসবিদদের উচ্চারণে কিছু বয়ান গুরুত্বপূর্ণ। ভারতবর্ষে শিক্ষা বিস্তারে মেকলে উৎসাহী ছিলেন।উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষে ব্রিটিশ অনুকারী এক ধরনের মধ্যস্থতাকারী তৈরি করা। প্রাট নামক ভদ্রলোক একই ভাবে ভারতীয়দেরকে ব্রিটিশ শাসনের মধ্যস্থতাকারী কোলাবোরেটরের শ্রেণী হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। এটিই ছিল তৎকালীন শিক্ষার মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদের চিন্তাকে প্রমোট করার উপায়মাত্র। তাদের কাছে, এই অঞ্চলের জন্য শুদ্ধ-নিঃস্বার্থ জ্ঞানার্জন পুরোপুরিই অবান্তর। ১৮৬০ এর দিকে প্রকাশিত হডগসন প্রাট এর রচিত গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায় এমন কিছু –

“University Education in England for Natives of India: Considered with a view to qualify them for the learned professions or the public service and to create a class who shall mediate between the Indian people and their English rules.” এই উপনিবেশিক শাসনের সাফল্যের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে “প্রশ্নহীনভাবে বিশ্বাসযোগ্য একদল কোলাবোরেটর” শ্রেণীর সৃষ্টি করা এবং সেক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসন কত দিক দিয়ে সচেষ্ট ছিল তার প্রমাণ হিসেবে এই গ্রন্থটি বিবেচ্য।


১৮৮০ থেকে বর্তমান সাল পর্যন্ত এই যুগটির নাম ছিল মনোপলি বা একচেটিয়া পুঁজিবাদী আমল, যে সময়কালে মুনাফার হারকে ঠেকানো হয় দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলিতে অসম বৃদ্ধির দ্বারা। অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে অধিক সুদের বিনিময় তার সাথে চুক্তি, সেই সাথে সামাজিক ভাবে নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে দূর্বলতা এবং চিন্তাগতভাবে প্রগতির উন্নয়নকে ঠেকিয়ে রাখা –এটিই অসম উন্নয়ন। এভাবে ধনী রাষ্ট্রগুলোর দ্বারা অসম বিনিময় প্রথা অসমতাকেই পুনরুৎপাদিত করেছে, যেখানে ধনী দেশগুলো উপনিবেশবাদ স্থাপনের মাধ্যমে আর্ন্তজাতিক শ্রম বিভাজন করেই চলছে। দরিদ্র দেশগুলোর উন্নয়নকে তাই ‘অনুন্নয়নের উন্নয়ন’ বলা হয়। এরা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটাবে ,তবে দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নে সেটা অনুপস্থিত রইবে। একই রকম উৎপাদনশীল শ্রমিক বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন হারে মজুরি পাচ্ছে, এভাবেও অসম বিনিময়ের দ্বারা মার্জিনালাইজড সোসাইটির সৃষ্টি হচ্ছে, ফলে সামাজিক ক্রিয়ার বৈষম্যের খেলা লুফে নিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। এই অসম বিনিময় হচ্ছে উত্তরের শ্রমিকের এক ঘন্টার উৎপাদনশীল শ্রমের সাথে দক্ষিণের শ্রমিকের বহু ঘন্টার শ্রমের বিনিময়। 


আমলাতান্ত্রিক ব্যয়মুখীতা,দ্রুত নগরায়ণ ও অর্থনীতির কাঠামোর মধ্যে ভারসাম্যহীনতা, দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বৈজ্ঞানিক উপায়ে সৃষ্ট কৃষিজ পণ্যে আমদানী নির্ভর ও ভারী শিল্পের মধ্যে প্রবেশ ত্যাদি পশ্চিমাদের ১৯৯০ সালের পরবর্তী সময়কাল থেকে সফলতম বৈশিষ্ঠ্য। দরিদ্র দেশগুলোই নিজেদের শোষণকে অর্থায়ন করে থাকে। পারস্য থেকে তেলের উপর যে মুনাফা আসে তা কর্পোরেশন পুনরায় তৃতীয় বিশ্বের উপর ব্যয় করে মনস্তাত্ত্বিক সাম্রাজ্যবাদকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই। বাস্তবে পুঁজি এখানে কোনো সমতাই তৈরি করছে না বরং মেরুকরণ সৃষ্টির মাধ্যমে বর্ণবাদ, শ্রেণীকরণ, সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণকে টিকিয়ে রাখছে। ফ্যাসিবাদী চরিত্র অনেকটাই। দক্ষিণের দিকে পাশ্চাত্যের সবচেয়ে বড় প্রজেক্ট হলো ‘জাতীয়তাবাদী বুর্জোয়া মতাদর্শকে’ স্থাপন করা। সেই সাথে সে অনুযায়ী অর্থনীতিকে পরিচালনা করা। যে কোনো ধরনের পপুলিস্ট আন্দোলনের পেছনে পশিমারা অন্যতম ভূমিকা রাখতে পারে এই সুবাদে। কিন্তু সামির আমিনের মতে ,”জাতি পুঁজিবাদের ফসল এবং এটি রাষ্ট্রীয় সহিংসতা ও পুঁজিবাদী বাজার দ্বারা নির্মিত”।সামির আমিনের পাঠ থেকে যা পাওয়া যায় তা হলো ,আধিপত্যমুক্তি প্রয়োজন যাকে তিনি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করণ কলেন। তুলনামূলক পাশ্চাত্যমুখী সুবিধাতত্ত্বকে পেছনে ফেলে মৌলিক পণ্যের চাহিদাকে সামনে তুলে ধরা উচিত, যার ফলে অনেক দেশকে আমদানী কৃত খাদ্যের উপরে নির্ভরশীল হতে হবে না। আমিন বিশ্বাস করেন, পুঁজিবাদী যুক্তি ও তার বিরোধী সামাজিক সংঘাতের মধ্য দিয়েই ইতিহাস অগ্রসর হয়।

Comments

Popular posts from this blog

পোস্ট মর্ডানিজম :ভাবনাচিন্তা ও তত্ত্ব

মিশেল ফুকোঃ জ্ঞান,শৃঙ্খলা এবং ক্ষমতা

১৯ শতকে বাংলায় সমাজ সংস্করণ এবং ধর্ম সংস্কার