সংস্কৃতি কি এবং কেন ? বাঙালী সংস্কৃতির ইতিহাস নিয়ে একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা।
একজন মানুষের
পরিশীলিত মন মার্জিত রুচি ও ব্যাবহারই হলো সংস্কৃতি। অন্যভাবে বলতে গেলে সমাজে
বসবাস করতে গিয়ে মানুষ যে সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করে তাই সংস্কৃতি। সংস্কৃতি
শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো culture। এই culture
শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ colere(কর্ষণ) থেকে। অতিপরিচিত সংস্কৃতি প্রত্যয়টির ব্যাবহার এবং
বিস্তৃতি ব্যাপক। কোনো একটি সমাজে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটির চরিত্র, মন কেমন হবে তা নির্ধারণ করে দেয় এই সংস্কৃতি। এই ব্যাপক একটি
বিষয় কে কোনো নিদিষ্ট সংজ্ঞায়নের মধ্যে আনাটাও অত্যন্ত কঠিন একটি কাজ।সংস্কৃতি কে
অনেকে অনেক ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন আমরা তার মধ্য থেকে কিছু সংজ্ঞায়ন নিয়ে
কথা বলার চেষ্টা করবো। সমাজতাত্ত্বিকগণ সংস্কৃতি কে দেখেছেন মানুষের সার্বিক জীবন প্রণালী
হিসেবে(the way of life), অর্থাৎ
সংস্কৃতি হলো আমাদের গোটা জীবন ধারা।এ প্রসঙ্গে সমাজ বিজ্ঞানী ম্যাকাইভার (macIver)
বলেন, " culture is what we are and
civilization is what we use or have." অর্থাৎ
আমরা যা তাই সংস্কৃতি এবং আমাদের যা আছে অথবা আমরা যা ব্যাবহার করি তা হলো সভ্যতা। মূলত মানুষের
চিন্তা-ভাবনা, কল্পনা,
আচার-আচরণ ইত্যাদি কে বোঝানোর জন্য সংস্কৃতি প্রত্যয়টি
ব্যাবহার করা হয়েছে। এখানে সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে একই সারিতে দেখানো হয়েছে ফলে সভ্যতা ও
সংস্কৃতির সম্পর্ক দেখানোর প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। সভ্যতাকে সহজ ভাবে বলতে গেলে বলা যায় সভ্যতা
মানুষের এমন এক সাফল্য যা উচ্চতর সংস্কৃতি কে নির্দেশ করে।একটি সংস্কৃতিতে সভ্যতার
অস্তিত্ব থাকে না কিন্তু সভ্যতার অস্তিত্ব মাত্রই আমরা একটি পরিশীলিত সংস্কৃতিকে
কল্পনা করতে পারি। উদাহরণস্বরুপ, আমরা
হয়তো মেহেরগড় সভ্যতার নাম শুনে থাকতে পারি।এটি হলো একটি আদিম কৃষি ভিত্তিক সমাজ।
এই মেহেরগড়কে অনেক ইতিহাসবিদ সভ্যতার মর্যাদা দেন না বরং একটি সংস্কৃতি হিসেবে
পরিচয় করান। দার্শনিক কান্ট সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ব্যাখ্যা করেন এভাবে যে,"
সভ্যতা হলো মানুষের বাহ্যিক আচরণ। সভ্যতার
প্রতিফলন সুস্পষ্ট। কোনো দেশের চাকচিক্য দেখে সে দেশের সভ্যতা সম্পর্কে কিছুটা
আন্দাজ করা যায়। অপরদিকে সংস্কৃতি হলো মানুষের ভেতরের দিক। কোনো দেশের সংস্কৃতি
সম্পর্কে ধারণা পেতে হলে সে দেশের মানুষের নিবিড় সংস্পর্শে আসা প্রয়োজন"। অর্থাৎ
সংস্কৃতি আমাদের দক্ষতা,জ্ঞান,
ধ্যান-ধারণার ও আচার-আচরণে অর্থাৎ মনোজগত
কেন্দ্রিক বিষয়কে নির্দেশ করে।অন্যদিকে সভ্যতার একটি যান্ত্রিক প্রতিফলন রয়েছে।
মানুষের ইচ্ছা আকাঙ্ক্ষা পুরণের একটি বিশেষ কৌশল হলো সভ্যতা। জোনস (jones)
এর মতে, "culture is the sum of
man's creations". অর্থাৎ
মানবসৃষ্ট সবকিছুর সমষ্টিই হলো সংস্কৃতি।মানুষ তার প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে প্রাচীনকাল
থেকে যা কিছু সৃষ্টি করে আসছে তার সবটাই সংস্কৃতি। ক্লুখন(kluckhon) এর মতে,"culture is the total life way of a
people".অর্থাৎ সংস্কৃতি হলো মানুষের সার্বিক
জীবন পদ্ধতি। সমাজের মানুষ তার জীবনে যা করে।সেটাই সংস্কৃতি হিসেবে পরিগনিত হবে।
"মার্ক্সীয় ধারণায় সংস্কৃতি মূলত
অর্থনীতি দ্বারা প্রভাবিত। সংস্কৃতি হলো উপরি কাঠামো।মৌল কাঠামোর উপর ভিত্তি করে
গড়ে উঠে উপরি কাঠামো। মৌল কাঠামো হচ্ছে সমাজের অর্থনৈতিক ভিত্তি।কোনো সমাজের
অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যাবস্থার উপর ভিত্তি করে সে সমাজের সংস্কৃতি গড়ে উঠে"। ম্যাক্স
ওয়েবার( max weber) এর মতে
সংস্কৃতি উন্নয়নের গতি প্রকৃতির নিয়ন্ত্রক। অর্থাৎ সংস্কৃতি কে একটি ব্যবস্থা ও
ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।যেখানে এই ব্যবস্থাগুলো আন্তঃসম্পর্কিত এবং প্রত্যেকটি
সমাজের ক্রিয়াগত প্রয়োজন পূরণ করে। ট্যালকট পারসন্স (Talcott parsons) এর মতে, " culture is a product and
also a determinant of human interaction".অর্থাৎ মানব মিথস্ক্রিয়ার ফল বা নির্ধারকই হলো সংস্কৃতি। তার মতে
সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য তিনটি। এগুলো হলোঃ
১.সংস্কৃতি কোনো একক বিষয় নয়।এটি কোনো গোষ্ঠী বা
সম্প্রদায়ের অভিন্ন সম্পদ, যা
বিভিন্ন ভাবে এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে ব্যাপ্তি লাভ করে।
২.সংস্কৃতি কোনো জন্মগত বা সহজাত বিষয়
নয়।সংস্কৃতি শিক্ষালব্ধ।
৩.সংস্কৃতি গতিশীল। এটি একস্থান থেকে অন্যস্থানে,এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে অনুপ্রবেশ করে। নৃবিজ্ঞানীদের
মতে যেকোনো প্রকার উদ্ভাবনই সংস্কৃতি।
ই.বি টেইলর (E.B. Taylor) এর মতে, "culture is that complex
whole which include knowledge, belief, art, moral, law, custom and any other
capabilities and habits acquired by a man as a member of society". অর্থাৎ সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত আচার-আচরণ,
ব্যাবহার, জ্ঞান, বিশ্বাস,
শিল্পকলা, রীতি-নীতি, প্রথা,আইন ইত্যাদির জটিল সমাবেশ হলো সংস্কৃতি। সংস্কৃতির
অন্যসব সংজ্ঞায়নের মধ্যে এটি সবচেয়ে বেশি গ্রহনযোগ্য। এই অনুসারে সংস্কৃতি হলো
ব্যাক্তির আচার এবং সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার অর্জিত সকল গুনাবলি।মানুষ সংস্কৃতির
বিষয় গুলো ধীরে ধীরে গ্রহণ করে।এই গ্রহণ প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্টানিক,
সচেতন ও অসচেতনভাবে সম্পন্ন হয়। ম্যালিনোস্কি (Malinowski)এর মতে, "culture is the handiwork
of man through which he achieves his ends". অর্থাৎ মানুষের এমন সব কর্মই সংস্কৃতি যার দ্বারা সে তার উদ্দেশ্য
চরিতার্থ করে। মানুষ তার অস্তিত্বের নিশ্চয়তা বিধানের লক্ষ্যে যা কিছু সৃষ্টি
করেছে তাই সংস্কৃতি। হোবল(Hoebel) এর মতে,
" culture is the sum total of integrated learned behaviour patterns which
are characteristics of the members of society and which are therefore not the
result of biological inheritance".অর্থাৎ
সমাজের একজন সদস্য হিসেবে সার্বিক জীবনে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জিত
আচার-আচরণই হলো সংস্কৃতি যা জন্মগত বা সহজাত নয়।
সংস্কৃতির কিছু সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে যার
দ্বারা আমরা সংস্কৃতি কে চিহ্নিত করতে পারি কিংবা আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয় থেকে
করতে পারি। সেই
প্রয়োজনীয়তা থেকে নৃবিজ্ঞানী হারসকোভিটাস(Herskovitas) ও উইসলার (Wislar) সংস্কৃতির
কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেন। এগুলো হলোঃ
১.স্থানভেদে
সংস্কৃতির ভিন্নতা দেখা যায়।
২. মানুষই সংস্কৃতির একমাত্র ধারক ও বাহক।
৩.সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল।
৪.সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে সংস্কৃতিতে মিল এবং আমিল লক্ষ্য করা যায়।
৫.সংস্কৃতির মধ্যে দ্বন্ধ (inevitable)...।
৬. সংস্কৃতি সবসময় বিনিময়যোগ্য।
৭.সামাজিক কাঠামো সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করে।
সংস্কৃতির উপাদান সমুহঃ
সংস্কৃতির অনেক উপাদান রয়েছে। সংস্কৃতি কে বোঝার স্বার্থে উপাদানের ভিত্তিতে দুই ভাগে ভাগ করা যায়;
১. বস্তুগত সংস্কৃতিঃ বস্তুগত সংস্কৃতি হলো মানুষের অর্জিত সেইসব গুনগত সাফল্য যার মাধ্যমে প্রধানত বোঝা যায় মানুষ প্রকৃতিকে কতটুকু আয়ত্তে এনেছে। যেমনঃ ঘরবাড়ি, চেয়ার-টেবিল, জামাকাপড় ইত্যাদি।
২.অবস্তুগত সংস্কৃতিঃ মানুষের সংস্কৃতি যখন বস্তু আকারে প্রকাশিত হয় না বা বাস্তব রূপ ধারণ করে না তাকে বলা হয় সংস্কৃতির অবস্তুগত উপাদান। যেমনঃ মানুষের জ্ঞান, ধারণা, কৌশল, চিন্তা-ভাবনা, সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম, আদর্শ, মূল্যবোধ ইত্যাদি।
Function of culture :
১. সংস্কৃতি মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে।
২.সংস্কৃতি ভাষার মাধ্যমে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে সম্পর্ক রাখতে সাহায্য করে।
৩.সংস্কৃতি ভালো-খারাপ, সুন্দর-অসুন্দর এর পার্থক্য নির্ণয় করে দেয়।
৪.সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় লক্ষ্য একজন মানুষ কে সামাজিক বানানো।
৫.সংস্কৃতি একজন মানুষকে শক্তিশালী করে। বলার অপেক্ষা রাখেনা সেটা শারীরিক নয়।
৬.মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সংস্কৃতি মৌলিক অধিকারের মতই গুরুত্বপূর্ণ।
সাংস্কৃতিক অঞ্চলঃ
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের উপর ভিত্তি করে সাংস্কৃতিক অঞ্চল গুলোকে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলোঃ
১.মধ্যপ্রাচ্য
২.ইউরোপ
৩.আফ্রিকা
৪.উত্তর এশিয়া
৫.দক্ষিণ এশিয়া
৬.ওশেনিয়া
৭.উত্তর আমেরিকা
৮.ল্যাটিন আমেরিকা
আমরা যদি লক্ষ্য করি দেখতে পাব অঞ্চলভেদে সংস্কৃতির অনেক ভিন্নতা রয়েছে। এমনকি একটি সমাজের বিভিন্ন মানুষের মধ্যে ও এটি লক্ষ্য করা যায়। এই ভিন্নতার অনেক গুলো কারণ রয়েছে। আমরা তার মধ্যে থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ আলোচনা করবঃ
১.ভৌগলিক
২.শ্রম বিভাগ
৩.professional sub culture
৪. মানব কেন্দ্রিকতা।
৫.ভাষা ও ধর্মীয় পার্থক্য।
তাহমিদ আল মুদাসসির চৌধুরী
শিক্ষার্থী
বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
২. মানুষই সংস্কৃতির একমাত্র ধারক ও বাহক।
৩.সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল।
৪.সামাজিক অবস্থানের ভিত্তিতে সংস্কৃতিতে মিল এবং আমিল লক্ষ্য করা যায়।
৫.সংস্কৃতির মধ্যে দ্বন্ধ (inevitable)...।
৬. সংস্কৃতি সবসময় বিনিময়যোগ্য।
৭.সামাজিক কাঠামো সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করে।
সংস্কৃতির উপাদান সমুহঃ
সংস্কৃতির অনেক উপাদান রয়েছে। সংস্কৃতি কে বোঝার স্বার্থে উপাদানের ভিত্তিতে দুই ভাগে ভাগ করা যায়;
১. বস্তুগত সংস্কৃতিঃ বস্তুগত সংস্কৃতি হলো মানুষের অর্জিত সেইসব গুনগত সাফল্য যার মাধ্যমে প্রধানত বোঝা যায় মানুষ প্রকৃতিকে কতটুকু আয়ত্তে এনেছে। যেমনঃ ঘরবাড়ি, চেয়ার-টেবিল, জামাকাপড় ইত্যাদি।
২.অবস্তুগত সংস্কৃতিঃ মানুষের সংস্কৃতি যখন বস্তু আকারে প্রকাশিত হয় না বা বাস্তব রূপ ধারণ করে না তাকে বলা হয় সংস্কৃতির অবস্তুগত উপাদান। যেমনঃ মানুষের জ্ঞান, ধারণা, কৌশল, চিন্তা-ভাবনা, সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম, আদর্শ, মূল্যবোধ ইত্যাদি।
Function of culture :
১. সংস্কৃতি মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে।
২.সংস্কৃতি ভাষার মাধ্যমে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে সম্পর্ক রাখতে সাহায্য করে।
৩.সংস্কৃতি ভালো-খারাপ, সুন্দর-অসুন্দর এর পার্থক্য নির্ণয় করে দেয়।
৪.সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় লক্ষ্য একজন মানুষ কে সামাজিক বানানো।
৫.সংস্কৃতি একজন মানুষকে শক্তিশালী করে। বলার অপেক্ষা রাখেনা সেটা শারীরিক নয়।
৬.মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সংস্কৃতি মৌলিক অধিকারের মতই গুরুত্বপূর্ণ।
সাংস্কৃতিক অঞ্চলঃ
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের উপর ভিত্তি করে সাংস্কৃতিক অঞ্চল গুলোকে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলোঃ
১.মধ্যপ্রাচ্য
২.ইউরোপ
৩.আফ্রিকা
৪.উত্তর এশিয়া
৫.দক্ষিণ এশিয়া
৬.ওশেনিয়া
৭.উত্তর আমেরিকা
৮.ল্যাটিন আমেরিকা
আমরা যদি লক্ষ্য করি দেখতে পাব অঞ্চলভেদে সংস্কৃতির অনেক ভিন্নতা রয়েছে। এমনকি একটি সমাজের বিভিন্ন মানুষের মধ্যে ও এটি লক্ষ্য করা যায়। এই ভিন্নতার অনেক গুলো কারণ রয়েছে। আমরা তার মধ্যে থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ আলোচনা করবঃ
১.ভৌগলিক
২.শ্রম বিভাগ
৩.professional sub culture
৪. মানব কেন্দ্রিকতা।
৫.ভাষা ও ধর্মীয় পার্থক্য।
তাহমিদ আল মুদাসসির চৌধুরী
শিক্ষার্থী
বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাঙালী সংস্কৃতি এবং তার ঐতিহাসিক
পর্যালোচনা
সাংস্কৃতিক অঞ্চল
হিসেবে দক্ষিণ এশীয় সংস্কৃতিতে “বাঙালী সংস্কৃতি” এর প্রভাব অনবদ্য এবং খুবই শক্তিশালী।
বাঙালী সংস্কৃতি শুধু মাত্র ইংরেজ শাসনামল কিংবা মুঘলকে ঘিরেই এক জায়গায় আবদ্ধ নয় কারণ
সংস্কৃতির ধারণায় মিথস্ক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং সেই সাথে ঐতিহাসিক
পর্যালোচনা সাপেক্ষে সেই বাঙালী সংস্কৃতির মানেই হলো যখন থেকেই বাঙালী জাতির জন্ম ঠিক
সেই সময় থেকে তার জীবন নির্ধারণের জন্য এবং সার্বিক প্রয়োজনের সাপেক্ষে সে জাতি যা
যা সৃষ্টি করে গিয়েছে নিজের জাতির জন্য, তাই হলো সম্পূর্ণ্রূপেই বাঙালী সংস্কৃতি। বর্তমান যুগে এই বাঙালী সংস্কৃতি কেউ কেউ বৈজ্ঞানিক নৃতত্ত্ব,কেউ
জাতি তত্ত্ব,অধ্যাত্ন সম্পদের উপর নির্ভর করে নানান রকম তত্ত্বের সৃষ্টি করেন। পুরো ভারতজুড়ে
বাঙালী শ্রেফ একটি আলাদা সত্ত্বার অধিকারী জাতি। সুতরাং সমগ্র ভারতীয় মহাসংস্কৃতি
থেকে একটি অংশ বাঙালী সংস্কৃতি। পুরো ভারতের অংশকে তাই বয়কট করা সম্ভব নয় কারণ
বাঙালী সংস্কৃতির ধারাকে বুঝতে হলে পুরো ভারতের সংস্কৃতিকেও বুঝাটা
গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় সংস্কৃতির জগৎ থেকে
বিচ্ছিন্ন করলে বাঙালী সংস্কৃতিকে বুঝা সম্ভবপর হবে না।
সংস্কৃতি হলো সেই
ধারণা যা নিজের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে না, অতীতকে সে বর্তমানের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখে
এগিয়ে চলছে ।বাঙালী এই ধারাতে তার নিজস্বতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে তার
নিজের ভাষার উৎপত্তির দরুণ ঠিক যেভাবে হিন্দি,মারাঠি,গুজরাটিরাও জাতি হিসেবে
শক্তিশালী হয়েছিল তাদের স্ব স্ব ভাষার প্রভাবে। ভাষা হলো জাতীয়তাবাদের একটি
গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যার ফলেই ভারতীয় সমগ্র সংস্কৃতি থেকে বাঙালী নিজেকে
স্বতন্ত্রের জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছে। এখানে
মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোরও প্রভাব রয়েছে। কোনো জাতির সংস্কৃতি তার বিশিষ্ট মানসিক
ভঙ্গিমার যেমন পরিচায়ক হয়ে উঠে ঠিক তেমনিভাবে বিশিষ্ট মানসিক ভঙ্গিমাও গড়ে ওঠে
আবার সেই সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে। আবার এই মানসিক-ভঙ্গিমা ও সংস্কৃতিও (হতে পারে
বস্তুগত এবং অবস্তুগত) আবার তাদের বিকাশের জন্য নির্ভর করে সেই জনসমাজের আবাস ভূমি, তাদের ঐতিহাসিক
অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস,আর্থ সামাজিক পেক্ষাপট,জীবন পদ্ধতি। এই রূপগুলোর দরুণ “বাঙালী”
হিসেবে সে নিজেকে অন্যের থেকে পৃথক করে নেয় এবং তা নিজস্বতার বলয়ে আবদ্ধ হয়ে একটি
কমন চিন্তাধারাকে একবদ্ধ করে একটি “বাঙালী সংস্কৃতি” ভিত্তিক সমাজকে গড়ে তুলে। ঠিক
এই ভাষাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি করে নিজস্ব সংস্কৃতি গুলোকে যা নিজস্ব পরিচয়ে বহনে
সক্ষম করে তুলে। জাতি গঠনের বেলায় বাঙালী অন্যান্য ভারতীয় হিন্দি, মারাঠি বা
গুজরাটি ভাষাভিত্তিক জাতিদের চেয়ে আলাদা, স্বতন্ত্র মতবাদ ভিত্তিক জাতিতে রূপান্তর
হয়।
এক্ষেত্রে আমরা যদি লক্ষ্য করে থাকি তবে বিভিন্ন সূত্র হতে
প্রাপ্ত ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে - বাঙালী সংস্কৃতির জন্ম এমন একটি সময়ে অবস্থিত যখন
গুপ্তযুগ শেষ হয়েছে, পালযুগ চলছে ,সেনযুগ সামনে আসছে। এই সময়কালটি ধরতে গেলে ৮০০ খ্রি.। এই যুগ শেষ হলে মধ্যযুগের সূত্রপাত
বখতিয়ার খিলজির বাংলায় আক্রমণের সময়কালটাই ,তুর্ক বিজয়কাল অর্থাৎ ১২০৩ খ্রি.। এর
পর থেকে শুরু মধ্য যুগ। মধ্য যুগ শেষে ১৮০০ থেকে ১৯৪০ এর সময়কালটি যা ইংরেজ
শাসনামলের কাল। নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো সময়কালকে ঘিরেঃ
প্রাথমিক যুগ (৮০০-১২০০ খ্রিঃ)
এ সময়কালটি বাঙালী সংস্কৃতির পূর্বকাল নামে পরিচিত এবং এই সময়কালের বৈশিষ্ঠ্য বিভিন্ন
পন্ডিতদের সেই সময়কালের অনুশাসন থেকে পাওয়া যেত। সেই অনুশাসন প্রকৃত অর্থে রাজা অভিজাতদের,সাধারণ
লোকদের অবস্থা সম্পর্কে অবগত করতেন। আবার অনেক সংস্কৃত গ্রন্থে উচ্চবর্গের মানুষের
আশা আকাঙ্ক্ষা, কল্পনা -ভাবনা, বিলাসিতা ও জীবনের আভাস ইত্যাদি তুলে ধরা হতো। আর নিম্নস্তরের
কিংবা সাধারণ মানুষের ভাষা ও ভাবনাকে তুলে ধরেছে “চর্যাপদ” ও “দোহাকোষ” এর মতো গ্রন্থাবলী।
আর এই পূর্ব ইতিহাসে বাঙালীর জীবনযাত্রা ছিল পুরোপুরি পল্লীভিত্তিক, কৃষিভিত্তিক। সেখানে
জীবিকা সংগ্রহ করতো ডোম,জেলে, বাগদী,মাঝি ইত্যাদি। রাষ্ট্রে নতুন করে সৃষ্টি হয় এক
সামন্তের অবস্থান। সামন্ত অর্থাৎ যেখানে জমির উপর কর্তৃত্ব আরোপ করে রাজাদের শাসন প্রভাব
বিস্তৃত করার প্রক্রিয়া। আর সেই সময় এই প্রক্রিয়া সাধন হয় ব্রাক্ষণদের জমি দানের মাধ্যমে।
সেই সময়কালেই আবার বণিকশ্রেণীর জন্ম হওয়া শুরু করে ফলে তার একটি সংঘর্ষের সৃষ্টি করে
রাজা-ব্রাক্ষণ বনাম বণিক শ্রেণী। সেন রাজার আমলে থাকাকালীন কৌলিন্য প্রথা চাপিয়ে দেবার
মাধ্যমে অত্যাচার পাকাপোক্ত করেছে বণিকদের উপর, সেন রাজার বিরোধী জাতিদের রাখলেন দমিয়ে
এবং চাপের মুখে। এ সময়কালের শেষের দিকে হরেক রকমের উচ্ছৃঙ্খলতা ও অকর্মণ্যতার কাহিনি
সৃষ্টি হওয়া শুরু করে। সামন্ত প্রভু বনাম বণিক শ্রেণীর এই সম্পর্ক গড়ন ও ভঙ্গন ইত্যাদির ক্রমাগত ধারা বইতেই থাকে। মার্ক্সীর
ধারণায় আমরা দেখতে পাই এই সম্পর্ক নির্ভর করে উৎপাদন সম্পর্কের উপরে। ঠিক এই উৎপাদন
সম্পর্কের বিশাল সংঘর্ষ সেই সময় রাজাকে ভাবতে বাধ্য করিয়েছে তার ক্ষমতায়নের বিষয়টিকে,
বণিক শ্রেণীর জন্ম হলে অত্যাধিক তা রাজার ক্ষমতার সময়কালকে আরো নিম্নবেগে গতিশীল করে
দিবে। এই মর্মে তাদের মধ্যে একটি দা কুমড়ার সম্পর্ক তৎকালীন সময়ে স্থাপিত হওয়া শুরু
করে।
লোকাচারের দ্বারা সেই সময়ে একটি সংস্কৃতি গত ধারণা পাওয়া যায় যেমন – ব্রত,পার্বণ
,নাশ ইত্যাদি। সমাজের ভিতরে আজও এসবের প্রচলন আছে তবুও তা সংখ্যায় প্রচুর কম।
মধ্যযুগ
প্রথম পর্ব – ১২০০ থেকে ১৪০০ খ্রিঃ
এই যুগের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং সামাজিক বাস্তবতা যে সকল গ্রন্থ তুলে ধরেছে তা
হলো সংস্কৃত শাস্ত্র,কুলজী গ্রন্থ,জয়দেবের কবিতা সহ অন্যান্য কবিতাগুলোতেও। এই যুগে
রাষ্ট্রীয় চিত্র তুলে ধরতে সহায়তা করে “সেখ শুভোদিয়ার” ও “শূণ্যপুরাণ” এর মতো বইগুলো।
এই যুগের অন্যতম নিদর্শন “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”। তুর্কি বিপ্লবের পরবর্তীতে সামাজিক বিপর্যয়
ঘটলেও বনিয়াদ শ্রেণী তখনও অটল ছিল।
দ্বিতীয় পর্ব – ১৪০০ থেকে ১৬০০ খ্রিঃ
এই সময়কালে সামন্ত বাংলার একটি চিত্র ফুটে উঠে জোরদার ভাবে। তাও আমরা পাঠান রাজত্ব
ও বারো ভুইয়ার কালে দেখতে পাই। এই যুগে বাংলা সাহিত্যের ধারকার সূত্রপাত ঘটতে থাকে
আস্তে আস্তে এবং মোটামুটি অনেক রাজসভায় সাহিত্য নির্ভর সংস্কৃতির জাগরণের সৃষ্টি হয়।
হুসেন শাহের দরবারে, পরাগল খাঁ ,রোসাঙ্গের রাজসভায়। মুসলিম ও হিন্দু সমভাবেই বাঙলা
কাব্যরসে তখন আনন্দিত। অপরপক্ষে নবদ্বীপে প্রতিষ্ঠা হয় নৈয়াকিকদের। বৈষ্ণবযুগের প্রসার
চলতে থাকে এই সময়কালে। বিষ্ণুপুরের রাজসভা হয়ে উঠে বৈষ্ণব ধর্মের প্রধান কেন্দ্র। এই
যুগে সাহিত্য,শিল্পকলা, সংস্কৃতির প্রবাহ ইত্যাদি জোরদার চলতে থাকে।
তৃতীয় পর্ব – ১৬৫০ থেকে ১৮০০ খ্রিঃ
মোঘলের বিজয়ের দ্বারা এই সময়কালের সূত্রপাত ঘটে। ভারতের সর্বঅঙ্গের সাথে বাংলার
যোগাযোগ আরো বৃদ্ধি পায়। টোডরমলের জমানা ধরে নতুন করে সামন্ত সৃষ্টি হলো। কেননা ঠিক
এই সময়কালে আস্তে আস্তে বিদেশী বণিক শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটা শুরু করে। অর্থাৎ কলোনিয়াল কালচার এর সাথে নিজস্ব কালচারের
একটি মিশ্রণের ধারার সূত্রপাত ঘটা শুরু করে।
এই দেশ বিদেশ বাণিজ্য প্রসারের ফলে সওদাগর শ্রেণির প্রভাব বাড়তে শুরু করে,পুরোনো
গন্ডি ভাঙতে থাকে। দরবারি সভ্যতার বিকাশ দেখা যায় মুর্শিদাবাদ ভিত্তিক এবং বর্গীদের
হাঙ্গামার দরুণ সামন্তের মাঝে একটি ফাটলের সৃষ্টি হওয়া শুরু করে। বিষ্ণুপুর হারিয়ে
যেতে শুরু করে কিন্তু নাটোরের বর্ধমান জেগে রয়।
ঠিক এই যুগেই রামায়ণ,মহাভারত প্রভৃতি পৌরাণিক কাব্য,মঙ্গলকাব্য,বৈষ্ণব সাহিত্য
-পদাবলী,জীবনী কাব্য,রসশাস্ত্র,কীর্তন ও সংগীতকলার যথেষ্ট অনুশীলন চলে। উচ্চশ্রেণির
মানুষদের মধ্যে সেই সময় অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের, কিছু সংখ্যক মুসলমান ছিলেন
যেমন আলাওল,দৌলত কাজী প্রভৃতি। এই সময় উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে
শহরের চাহিদার সৃষ্টি হয়। শহরের সৃষ্টি যতো দ্রুত হয় ততোই কারুশিল্পের প্রচলন ঘটতে
থাকে এবং সেই হিসেবে টোডরমলের নতুন জায়গাদারী ও ভূমি ব্যবস্থার নীতি প্রবর্তিত হয়।
এই ধারায় নতুন নতুন সংস্কৃতির সৃষ্টি হয় যা এখনও অক্ষুণ্ণ অবস্থায় রয়েছে যেমন পূজা
পার্বণ, মেলা,বাইচ,দৌড় ব্রত। উচ্চকোটির সৃষ্টির প্রভাব এসে ঠেকে মূল ধারার ঐতিহ্যবাহী
সংস্কৃতি গুলোর উপর যা হারিয়ে যাবার উপক্রম
ছিল প্রায়ই। এই সংস্কৃতিহুলো লোকসংস্কৃতি নামে পরিচিত।। উচ্চকোটির এই ইংরেজ মিথস্ক্রিয়ার
ফলে তাদের মধ্যে কলোনিয়াল কালচারের একটি প্রভাব ঢুকে পড়ে এবং শহরায়নের দরুণ উৎপাদন
সম্পর্কও ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে থাকে। তবুও এই যুগে এই লোকসংস্কৃতি গুলো টিকে ছিল
শুধু মাত্র গ্রামীণ বা সাধারণ জনগণের মধ্যখানে। যেমন অপুর্ব “ময়মনসিংহ গীতিকা”। এই
সময়ে নতুন করে সৃষ্টি হয় পারস্য ভিত্তিক সাহিত্য, জিন হুর পরি ভিত্তিক উপন্যাস। বৈষ্ণব
কীর্তন ছাড়াও আউল বাউল সহজিয়া প্রভৃতি ধারার গান, দেহতত্ত্বের গান, সূফীদের প্রাণাবেগ
ও সাধনায় প্রদীপ্ত মর্সিয়া ও মারফতি গান। সাধারণ
মানুষের মুখে ফুটে উঠতো জারি ,সারি,ভাটিয়ালী,বেদে গান,আগমনী,নবমী,বিয়ের গান।
আধুনিক যুগের এই সময়তেও এই লোকসংস্কৃতির ধারাগুলো অক্ষত
রয়েছে। ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে বিদেশী ভাবের পরেও পোড়ামাটির পুতুল,পাথরের
মূর্তি,হাতির দাতের কাজ,শাখার কাজ,কোলার কাজ,কাথের পুতুল,মাটির পুতুলের প্রচলন
আছে। সোনা রূপার নানা কাজ,নকশী তোলা,মীনার কাজও রয়েছে। কাসা পিতলের বাসন কোসন টিকে
আছে এলুমিনিয়ামের যুগেও। শাক,শুকান্তি,ছানার মিষ্টান্ন টিকে আছে,রসগোল্লা ও সন্দেশ
প্রভৃতি বানগালী কালচারের বাহন হিসেবেই খ্যাত। রেশমের কাজ হারিয়ে গেলেও ঢাকা,টাঙ্গাইল,
ফরাস ডাঙ্গা প্রভৃতিতে বস্ত্রশিল্পের আদি ধারণা গুলোও এখনও প্রচলিত। আচার
অনুষ্ঠানে বিবাহ শ্রাদ্ধ, ভাইফোটা,জামাই ষষ্ঠী,নবান্ন, নতুন হাল খাতা, কিংবা
মহররম,ইদ,শাহ মাদারের উৎসব অক্ষত। আলপনা কাথা সেলাই বেঁচে আছে এখনও। লাঠি
খেলা,কালিকাছের নাচ, রাইবেশের নাচও অচল হয়নি।
এই হারিয়ে যাবার পেছনে নতুন এক বাঙালী সংস্কৃতি দায়ী যাদের
উদ্ভব ইংরেজ আমলে অর্থাৎ কলোনিয়াল কন্সেপেটের মিথস্ক্রিয়ার আদলে গঠিত নব্য বাঙালী
সংস্কৃতির ধারণা। এই ধারণায় উচ্চকোটির শ্রেণীর লোকজনের সাহিত্য ও সংস্কৃতি থেকে
নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয় নিম্নকোটির থেকে কারণ তখন শিক্ষা,অর্থ গত ধারণায় এই
উচ্চকোটির লিপ্ত ছিল যা ইংরেজদের সফলতার মূল চাবিকাঠি। এই সময়ে অনেক মধ্যবিত্তের
সৃষ্টি হয়, সৃষ্টি হয় বাবু চাকরের কালচার। মধ্যস্বত্বভোগীরা ইংরেজ অর্থনীতির
ছায়াতলে বসবাস শুরু করে যার ফলে তাদের সংস্কৃতিতে একটি বিশাল ইংরেজ ছাপ পড়তে থাকে।
এই ছাপ পড়বার দরুণ সাধারণ “লোকসংস্কৃতি” হতে উচ্চকোটি বা মধ্যবিত্ত্ নিজেদের
গুটিয়ে ফেলে। অর্থাৎ আজও পর্যন্ত যদি এই লোকসংস্কৃতি টিকে থাকে তবে তার পুরো
কৃতিত্ব হলো সাধারণ মানুষ, পল্লীসমাজ ভিত্তিক, কৃষিভিত্তিক সমাজের লোকেদের কারণে।
শহরায়ণ যা ইংরেজ দের উন্নয়নের ধারণার মূল পরিকল্পনা এবং সেই সাথে ইংরেজ দর্শন
সৃষ্টি করার একটা সহজতর পন্থা সুতরাং শহরায়ণের ফলে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে
ও ইংরেজ ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি এই শ্রেণি ঝুকতে শুরু করে।
আধুনিক যুগ- ১৮০০ থেকে ১৯৪০ খ্রিঃ
এই যুগটাতে প্রবেশ করবার সাথে সাথেই রেনেসাঁ এর একটি প্রভাব
সংস্কৃতিতে বিরাজমান হয়। রেনেসাঁ এর অর্থ যদি জাগরণ হয় তবে বাঙালী সংস্কৃতিতে
রেনেসাঁ আসলো নতুন করে ভাবনা চিন্তা ও পরিবর্তনের জাগরণের আভাস নিয়ে। এর মাধ্যমে
ভারতে খুজে পাবার এবং অতীতকে আবিষ্কার করার একতা চাবিকাঠির সৃষ্টি হয়েছে। এই
বাঙালীর জাগরণের আসল প্রেরণা এসেছে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির কারণে। ১৮০০ থেকে
১৮৪০ সালের দিকে এই জাগরণের একটি নব উদয় হয়, রাজা রামমোহন রায়। ধর্ম সংস্কার,রাজনৈতিক সংস্কার,সমাজসংস্কারের
একটি ইঙ্গিত বয়ে আনেন। ডেভিড হেয়ারের শিক্ষা দান নীতি,ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠা
এবং সেই সাথে বাংলা সাহিত্যে নতুন গদ্যের বিকাশ যেন মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ওয়েলেসলি-ডালহৌসির
আমলে সামন্ত ব্যব্বস্থা ভাঙ্গে আর রেল,টেলিগ্রাফ প্রভৃতির সৃষ্টিতে বাস্তব ভিত্তির
রচনা হয়। এই সময়তেই ঘটে যায় সংস্কারের জন্য সিপাহী বিদ্রোহ ও সামন্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির সাথে সাথে জ্ঞান চর্চার একটি মাধ্যমের সৃষ্টি হয় যা
জনগণকে নতুন আলোর পথ বাতলে দিতে সহায়তা করে। এই রেনেসাঁর মধ্যে প্রবেশ করে মাইকেল মধুসূদন
ও দীনবন্ধু মিত্রের কাব্য প্রতিমা। রাজনৈতিক চেতনার আদলে গঠিত হওয়া শুরু করলো জাতীয়তাবাদের
ধারণা এবং পাশ্চাত্য সংস্কারী মনোভাব যেন সমাজ,রাজনীতি,অর্থনীতিতে প্রখরভাবে ছড়িয়ে
পড়লো। নতুন ধরনের সংগীত কলার আবিষ্কার ঘটে রবীন্দ্রনাথ এবং কাজী নজরুলের হাত ধরে। নতুন
ভারতীয় চিত্রকলার জন্ম এবং বাঙালী রেনেসাঁয় আর্ট কালচারের নির্ধারক গোষ্ঠীর জন্ম যেমন
যামিনী রায়, অবনীনদ্রনাথ ঠাকুর।বিজ্ঞানী হিসেবে জগদীশ চন্দ্র বসু, চিকিৎসা শাস্ত্রে
ডা ব্রম্মচারী, অর্থনীতিতে রমেশ চন্দ্র, ইতিহাসে রাজেন্দ্রলাল মিত্র, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী
। এই সময়েই উদারনৈতিক সংস্কারবাদী যাদের মধ্যে প্রধানত যুক্তিবাদ,দর্শন, সাহিত্যের
জ্ঞান প্রবেশ করে তাদের দ্বারা একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে জাতীয়বাদ রক্ষার
স্বার্থে। “জাতীয় গৌরব” নামক কন্সেপ্টের জন্য
দেবেন্দ্রনাথ,অরবিন্দ,স্বামী বিবেকানন্দ প্রভৃতি মানুষজনদের অবদান ছিল অসামান্য। এই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন মনস্তাত্ত্বিক
ভাবে আমাদের বয়ে নিয়ে চলে আধুনিকতার এক চূড়ান্ত ধারায়।
হাসনাইন ইমতিয়াজ সাকিব
শিক্ষার্থী
টেলিভিশন,ফিল্ম এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
Comments
Post a Comment